15 June, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

kobi

রমিত দে |প্রণব চক্রবর্তী | অমিতাভ মৈত্র |মাণিক সাহা |সব্যসাচী সান্যাল |জপমালা ঘোষরায় |রবীন্দ্র গুহ |ইন্দ্রজিৎ দত্ত |পীযূষকান্তি বিশ্বাস |সোনালী মিত্র |নীলাব্জ চক্রবর্তী |সুবীর সরকার |রাধে ঘোষ |রিমি দে |পায়েলী ধর |শমীক ষান্নিগ্রাহী |কুমারেশ তেওয়ারী |ফারাহ্ সাঈদ |শুভ আঢ্য | অগ্নি রায় |দীপঙ্কর দত্ত

প্রণব চক্রবর্তী


                           আমি একা, অনির্দেশ্য, দগ্ধ হই বিষাদের চুল্লির উরসে


                                                                   এক
কোনো অসম্পূর্ণতার ইতিহাস লেখার তাগিদে নয়, কোনো ক্রোমোজম হত্যালীলার গোপন গভীর ফুর্তির দায় নেই বোধিদ্রুম বেদনা রচনার, বলাত্কারে চিত্কৃত হাহাদৃশ্য বর্ণনার তরল অভিরুচি নেই মুমূর্ষু শব্দখেকোর--তথাপি এক বিনির্মাণের ভূত ক্রমশ তাড়া কোরে ফেরে অন্ধগলি খেরোখাতা অভিশপ্ত রসাতলে আসমুদ্র ভাসমান ভবিষ্যহীন মেঘ ও মেধার এক ধারাস্নানে প্লুত হবার কালো ও নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত আন্তঃরসায়ন--নিজেকেই ছিন্ন করার, নিজেকেই অবিমিশ্র ঘৃণা ও করুণার দায়ে বন্ধনহীন কোনো এক তির্যক পরিহাস। ইতিবৃত্ত ক্রমশ ধূসর জানি ক্রমশই নাগরিক চাহিদার গায়ে ঝুলে পড়ছে নগ্ন-বল্কল, বিশুদ্ধ চামড়ার গণিত-ব্যাকরণ-প্রথাসিদ্ধ জ্যামিতিক লয়। হাড়হাভাতের ক্লান্ত ঊরুর নীচে দমবন্ধ ক্ষুব্ধ নর্তকী প্রতিপল প্রার্থনায় মগ্ন ধ্বংস ও ক্ষয়......... তথাপি--

"কেন 'হয়তো' শ্রেয় হবে 'হয়েছে'-র থেকে ?" জিজ্ঞাসু অনন্য রায় সত্তরের সেই অগ্নিঋষি যার ফুত্কারে প্যান্টুলুন ভিজে যায় প্রতিষ্ঠানভিক্ষু কবিতা লিখিয়ের কলম ও নখের আভিজাত্য থেকে ছিটকে ওঠা কয়েকগুচ্ছ কাব্য-অভিরুচি। পালাতে পারি না, পড়ে যাই চিত্কারে বারংবার......বারম্বার--"আমি কলঙ্কিত করবো শাদা কাগজের কুমারী স্তব্ধতা/ অস্তির শিশিরবিন্দু মুঠো করে মিশে যাব ঘাসে /  আক্রোশে সৃজন করবো শব-ব্যবসায়ী এক ছন্দের দেবতা / গ্রন্থের কুয়াশা ছিঁড়ে জ্বলে উঠবো বজ্রমেহ ঊর্ণার আকাশে;''-- এবং আক্ষরিকভাবে 'নীল ব্যালেরিনা' কাব্যগ্রন্থের মাংস-পাঁজর-মেধাজুড়ে এই জ্বলে ওঠার এক চমত্কার আগ্নেয় পরিভ্রমণ।  রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলাভাষার নাক-ঢাকা শহুরে ভদ্রতায় চলনসই, মধ্যবিত্তীয় মেকী শালীনতায় দমবন্ধ কবি শব্দকে তো আর নাঙ্গা কোরে চকচকে বৈঠকখানায় ছুঁড়ে মারতে পারছেন না, অমনি রেরে কোরে পণ্ডিতদল বমন অভিপ্সায় স্ল্যাং শব্দের শ্মশান-ঘাটায় তাকে চুবিয়ে ঘাড় ধরে পাতালযাত্রার পথ সুগম করার ব্যবস্থা কোরে দেবে, কিন্তু যে কবির দায় সত্য বর্ণনের, যে কবির দায় আত্মার অভূতপূর্ব তেজস্ক্রীয়তায় কবিতার জরায়ু ফাটিয়ে গর্ভোত্পাদন-- সে তো তার পথ খুঁড়ে মুক্তি খুঁজবেই অতল পাতাল কিম্বা আরও কোনো নিষিদ্ধ গহনে। তাই তার অভিব্যক্তিজুড়ে মূর্ত হতে থাকে অন্য এক রসায়ন। শব্দ-সংগম। শব্দকে অন্য শব্দের তলপেটে সাঁটিয়ে উন্মত্ত ক্রীড়াময় এক একত্ব প্রদানের প্রচেষ্টা।  এক বোধিমুক্তির প্রদাহ। চূড়ান্ত বিপন্নতায় শব্দদল গুচ্ছগুচ্ছ ভাদুরে জন্তুর মত দৃপ্ত স্বাধীনতায় এ-ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢুকিয়ে নিচ্ছে অস্থির উত্তাপে। অর্থোৎপাদনের দায় নেই-- অর্থের অনর্থে বিচ্ছুরিত এক মহা ফূর্তি যেন। পুনর্নির্মিত অর্থের এক নবতম ধারাপাত।  আমূল ডিকন্সট্রাকশন্। কবিতার পর কবিতায় সেই শব্দ-সঙ্গমের দৃশ্যায়িত রতি-অভিযান।  মি-লর্ড, গোটাকয় দৃষ্টান্তযোগ্য সঙ্গমলীলা ফাইল থেকে উত্পাটিত হলো, মিলিয়ে দেখুন এ-বান্দা কেলুরাম কিনা, মিথ্যে বাগাড়ম্বরে প্রকৃতই বিভ্রান্ত করবার প্রয়াস আছে কিনা-- তাহলে সহজেই কেস গুলিয়ে-ডিমলেট করে দিলেই হবে :
১. অ্যানথ্রোপো-বিকেলে   ২. সঙ্ঘ-সোলারিস   ৩. মরালিটি-লতিকার   ৪. সত্য-সাবোটনিক   ৫. শূদ্রবীজ-পদ্মের   ৬. কসমিক-কোরকে   ৭. পোলকা-ডট-নক্ষত্রমেখলা   ৮. ক্রিটাশুস-ক্রান্তি   ৯. গ্রুনড্রিসে-সুরঙ্গ   ১০. ক্রেমলিন-বাণপ্রস্থে   ১১. কোয়ান্টাম-শান্তিনিকেতনে   ১২. ক্লস্ট্রো-পুঞ্জীভূত   ১৩. ক্লীবক্রীট-ট্রয়ের   ১৪. ভেষজ-জঙ্ঘায়

দ্বিতীয়ত, এই সব হাইফেন্ ঝঞ্ঝাটযুক্ত শব্দতুবড়ির বাইরেও সফল সংগমে উদ্ভূত এমব্রায়ো শব্দযূথ অর্থাৎ অত্যন্ত অহংকারে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ জারজ শব্দমালা যা বাংলাভাষার অভিধান রচয়িতার হার্টবীট বন্ধ কোরে দিতে যথেষ্টই সক্ষম :
১. ঊষাক্রুশে   ২. সৌরউরসের   ৩. কৃৎস্বপ্নে   ৪. অহল্যাসৈন্য   ৫. ব্যাঘ্রঋতু   ৬. কৃষিক্রুশে   ৭. গ্রহপিশাচী   ৮. নক্ষত্রকবরে   ৯. ম্যাক্রোরোদনের   ১০.  গ্রীনশব্দ   ১১. গ্ল্যাক্সোবন্দী   ১২. পুরোডাশ্   ১৩. কৃষিগেরিলার   ১৪. গেরস্থপ্রপাত...

তৃতীয়ত, বিশেষণ ও বিশেষণের বিশেষণ এবং তারও বিশেষায়িত ব্যবহারে কখনো ঠিকরে বেরিয়ে আসে অল্পশিক্ষিত পাঠকের অক্ষিবলয় :
১. সূর্যমুখী ক্ষুধাতুর লুমুম্বার পাখি   ২. পরজীবী কচ্ছপের সমকামী-পিতা   ৩. পার্পল ইল্বলে   ৪. কর্তিত লিঙ্গের হর্ষ   ৫.  মঙ্গলের লোলহাস্য মর্কটদূষণ   ৬. টুথব্রাশের বালালোলে   ৭. আর্ষ কালো অ্যাজেলিয়া   ৮. অর্থশাস্ত্রের মৃত্যুলীন হার্মনি   ৯. অটোমেটনের মর্ষে   ১০. ওঙ্কারধ্বনির ঊর্ণা   ১১. আঁউ-পাওয়া নগরে   ১২. এক পাঁইট পৃষ্ঠা   ১৩. বজ্রমেহ নক্ষত্রের শিঙা   ১৪. মাংসের নিষ্ফল বৈশাখের অন্ধডিঙা   ১৫. তুরুপের তেতো টেক্কা   ১৬. লুনার হলুদ ডোরাকাটা ফোঁটা   ১৭. ভ্রূণপিশাচীর পিশুন তাসের ঝড়   ১৮. পরজীবী পৃথু হাওয়ার ঊর্ণাজাল   ১৯. বৈশ্য শিলীভূত ব্যা-ব্যা   ২০. আমিষ মকর গর্ভে নিষ্ফল উপল জন্ম   ২১. লেহ্যলোহু ভাঙা বাংলাদেশ   ২২. ম্যাক্রোরোদনের শ্লথ দেবতার স্রস্ত অবলেশ   ২৩. অটোমোবাইলের পরাগলিপ্ত 'কেন'-লেহ্য লিঙ্গের ক্রেঙ্কার   ২৪. মৃত্যুর ছেনাল মায়ামর্ত্যে.......

পঞ্চমত, নীল ব্যালেরিনা কাব্যগ্রন্থের গোটা শরীর জুড়ে বেশ কয়েকটি শব্দের চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা কবির নিজস্ব শব্দকোষ থেকে ছিটকে উঠেছে বারবার। সম্ভাব্য ইঙ্গিতময়তায় নিষ্ঠ গবেষক কেউ এইসব শব্দগুলি ধরেই পৌঁছে যেতে পারেন কবির অন্তর্গহনের কোন অস্থির অস্তিত্বে, বেদনার কোন নিঃশব্দ নির্জনে, যেখান থেকে উঠে আসছে কবি-ব্যক্তিত্বের ভালো লাগা ও না-লাগার কোন নিজস্ব অভিজ্ঞান। গুটি কয় আপাতত যুক্তির সপক্ষে গেঁথে দিলাম :
১. রভসে   ২. ঊষাক্রুশ   ৩. উচ্ছ্রিত   ৪. উরসে   ৫. ঊর্ণা   ৬. বালালোল  ৭. কোরক   ৮. মৃত্যুযাপন............

                                                            দুই             

উড়ে যাচ্ছে ঘর গেরস্থালি মেঠোপথ, সংঘ, সড়ক, শতাব্দীপ্রাচীন 'নরখাদক ঐতিহ্যের' শিকড়, গুহাগান। নিবিড় নৈকট্যের ধ্যান ভেঙে জেগে ওঠা অন্য এক যোজন বিস্তৃত কুয়াশার পাদপীঠে লীন কোন অনিশ্চয়তার যূথ-সন্ত্রাস। সত্তর দশক। অস্থিরতার দশক। অচলায়তন নাড়িয়ে উপড়ে ফেলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখার দশক। প্রাতিষ্ঠানিকতার আমোদগেঁড়ে চিবুক থেকে আমোদ উড়িয়ে সন্ত্রাসমগ্ন পারিপার্শ্বিকে যৌবনকে নতুনভাবে প্রতিস্থাপিত করার দশক। মন্ত্র উড়ছে আকাশ ফাটিয়ে, মন্ত্রে উড়ছে প্রতিশ্রুতি নয়, চাই প্রয়োগ। ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, নীতিকথাকে সপাট চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আলকাতরায় চুবিয়ে উঠছে দেয়ালের চকচকে চিবুক।  আক্ষরিক অর্থে কালি মাখামাখি ঝুঁকিহীন রাজনৈতিক মাইক্রোফোনি তরজা। এযাবৎ শিখে আসা বর্ণমালাকেই চ্যালেঞ্জ করছে ক্ষুব্ধ সব যুবকের দল।  শিখতে চাই না আমরা "অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে, আ-য়ে আমটি খাবো পেড়ে"-- বরং অ-য়ে অজগর যদি তেড়েই আসে, আ-য়ে আমরা রুখবো তারে-- এমনটাই হওয়া উচিত ! এমনই সব প্রশ্ন ও সিদ্ধান্তের ধুন্ধুমারে জড়িয়ে যাচ্ছে সময়। আর এমনই এক সময়ের কবি অনন্য রায়। অস্থির সত্তরের এক নিঃসঙ্গ যুবরাজ যার মেধার ব্যাপ্তী কখনও ঈশ্বরকে সৃজনের আকাঙ্খায় গাঢ়, কখনও অতি সাম্প্রতিক বিজ্ঞান উন্মেষের পরিধি উড়িয়ে ঢুকে পড়ছে নবতম উন্মেষের ধূসর অলিন্দে। অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ফুত্কারে উড়িয়ে অত্যন্ত আধুনিক এক মানুষী-চেতনা কবিতার নির্মাণ ঘিরে গড়ে তুলছেন এমন এক রহস্যময় দুর্ভেদ্য জগৎ --যার কাছে যেতে হবে শিক্ষিত হয়ে। যার সৃজন-রসের আস্বাদ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন এক আধুনিক মন ও মেধা চর্চার নিষ্ঠ মগজ। তথাকথিত ভালো লাগানোর লিরিকসর্বস্ব পদ্যের বয়নশিল্পের প্রতি একান্ত নিস্পৃহ কবি তাই সহজেই বলে ফেলতে পারেন :

ঘোষাল স্ট্রিটের এঁটো গলি দিয়ে হেঁটে যায় ফিরিঅলা,
                     কচি কবি, বিখ্যাত মেয়র, দিশি হিজড়ে
  সকলেই গাল টেপে; কেউ বলে 'ব্যাটা হবে রবিঠাকুরের মত
                                                          সম্ভ্রান্ত কাবাব'।    (অপ্রাপ্ত বয়স্ক)

পাঠক লক্ষ্য করুন কতটা দুঃসাহসী হলে এতটা স্বতঃস্ফূর্ত রবিঠাকুরকে কাবাব বানিয়ে কবিতায় পরিবেশন করা যায়! পৃথিবীর ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান-দর্শন চিবিয়ে খাওয়ার তুখোর পৌরুষ না-থাকলে কারও পক্ষেই লিখে ফেলা সম্ভব নয় 'রক্তপরীক্ষা' নামক একটি অতি-বৌদ্ধিক কবিতা। তথাপি উল্লেখযোগ্য ভাবে পাঠককে ভাবিত করবেই এ কবিতার চমত্কার অ্যান্টি-পোয়েটিক গঠন নির্মাণ, তার বৌদ্ধিক বিন্যাস, দৃশ্যকল্প নির্মাণের চাতুর্য, সর্বপরি মেটাফোর ব্যবহারের অভিনবত্বে কবিতার অর্থ-তাৎপর্যের এক গূঢ় ব্যঞ্জনা। বরং বাংলা ভাষায় 'রক্তপরীক্ষা' লেখাটির রিপোর্ট আকারে অভিব্যক্ত অভূতপূর্ব দুটো-একটি পংক্তিকে স্মরণ করা যাক :

ইসিনোফিলস্: ১৪,৭৩৯ বার হাতঘড়ি-বিহারের স্বপ্ন-দেখা।
ব্যাসোফিলস্: ৪২৭ বার আত্মহননের কাতুকুতু।
অস্বাভাবিক শ্বেত রক্তকণিকা:
          ১,৮৬,২৬৪ মাইল মৃত্যুর কম্পাঙ্ক প্রতি মুহুর্তে
অস্বাভাবিক লোহিত রক্তকণিকা:
          ১৭৭৫ অ্যাডলফ হিটলার ও মেরী ম্যাগদালেন সঙ্গমরত।

পাঠক কি এক রাগী যুবকের মাইল-মাইল ব্যাপী ঘৃণা ও বিবমিষা টের পাচ্ছেন না প্রচলিত রাজনীতি, ধর্ম, জন্ম, মৃত্যু - সামগ্রিক অস্তিত্বের প্রতি ভয়াবহ সবাক লাথিতে ! এখানে স্বজন নেই, মুখ্য কোনো জীবাশ্মের অহংকার নিয়ে মিলিত হয়নি কোনো হোমোস্যাপিয়েন্স-- যেন এক চক্রিত অন্ধকারে জ্বলে যাচ্ছে আসমুদ্র তীব্র হাহাকার। মিথ্যেচারিতায় অভ্যস্ত যাপনজুড়ে সকলেই ব্যস্ত খুব খোসাওঠা দায়ভার মেটানোর গ্লানিতে। একদিকে পবিত্র পাপ, অন্যধারে হত্যা; সাম্রাজ্যবাদের নিষিদ্ধ কুলুঙ্গি থেকে খুঁটে তোলা জাতীয়তাবাদের তেলচিটে নামাবলী। চূড়ান্ত উষ্ণতায় সময়ের রক্তপ্রবাহে গমক উঠছে প্রতিমুহুর্তিক ষরযন্ত্র ও গুপ্তহত্যার ইশারায়।  এই তো সেই অস্বাভাবিক লোহিত রক্তকণিকা। পাঠক মনে রাখবেন রক্তপরীক্ষার রিপোর্টে নাম সই আছে-- অনন্য রায় (ইয়াঙ্কী শঙ্করাচার্য)। খেয়াল করুন সত্তরের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিভাবে আমেরিকান সংস্কৃতির খোলামেলা হাওয়ার ঘটা করে চলেছে উদ্বোধন ! অত্যন্ত সচেতন কবিমস্তিষ্ক তাই কত নির্বিবাদে এই হাইব্রিড কালচারের ডকুমেন্টেশন রেখে গেলেন শুধুমাত্র দুটি শব্দে 'ইয়াঙ্কী শঙ্করাচার্য'। আমরাও বাংলা কবিতায় পেয়ে গেলাম দৃষ্টান্তযোগ্য এক তীব্র পৌরুষ। মেদহীন লৌহশলাকা যেন-- চমক লাগায় না, বিদ্ধ করে সরাসরি। কিম্বা 'বিদুর' কবিতার নির্মাণকাল ২৫.৭.৮৩ তথাপি ২০১৬ তেও কতটা প্রাসঙ্গিক--

ফ্রী-মার্কেটের অক্ষক্রীড়া, পণ্যপূজার মেশিন-মাত্সর্য
ধন্য হলো দ্রৌপদীর বস্ত্র-ব্যবসায়ী ব্রিটিশ পুঁজির বলাত্কারে !
ভারতবর্ষ : ক্লীবের স্বর্গ ! দ্যূতসভার নগ্ন ঊরু, রজস্বলা কৃষির কক্ষপথে
সোনার চাঁদ পৃথুল হলো শ্রান্ত শ্রোণিভারে।

অনন্য রায় বেঁচে থাকলে বাংলার রাজনৈতিক অধ্যায়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বটাকে কিভাবে ব্যক্ত করতেন ভাবতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তাঁর কাব্যভাষা এতটাই আকস্মিক ও অমোঘ, এতটাই নিজস্বতা সে ভাষার অন্তঃপুর এমনকি বারদুয়ারী জুড়েও, 'ভারতবর্ষ: ক্লীবের স্বর্গ' গোছের দু-একটি পংক্তি বুক চাপড়ে আওড়ে দেওয়া যায় কিন্তু রপ্ত করা যায় না তার চলন।  বরং বুঝে নেওয়া যায় 'তাসের ঝড়' কবিতার-- "ষাঁড়ের শাঁসালো ধর্ষণে কাঁদে বাংলার পোড়া মাটি / কালো অ্যাজেলিয়া কোহলে গেড়েছে গলিত হওয়ার ঘাঁটি...." কিম্বা 'সাবাশ গর্ভপাত' কবিতার নষ্টভ্রূণ-কে সম্বোধন করে লেখা অমোঘ সেই পংক্তি--

বেবুশ্যে জননীর জন্যে কখনো খুঁজবে না তুমি হা-পিত্যেশ ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি
ছেলেকে ইস্কুলে গুঁজে পিছলে পড়তে হবে না তোমায় কোর্টকাছারির খোঁড়লে
এইবারের মত বেঁচে গেলে নষ্ট ভ্রূণ !
কোনোদিন শুনতে হবে না তোমাকে প্রবৃত্তি ও পরিবেশ নিয়ে স্কিনার-চমস্কির বিতর্ক
স্লেট-পেন্সিলের মোক্ষলাভ হবে না সংবিধানের সুন্নতে
ব্রেঁতর কবিতা পড়াবে না তোমাকে অস্ত্র উপাধ্যায়.....

........এই একই কবিতায় আরও এক ভয়াবহ পংক্তি লজ্জায় ফেলে দেবে অনেককেই, "বিহারে হরিজন-হত্যা হলে তুমি চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে এস্প্ল্যানেড অব্দি হাঁটবে না"..... না, নষ্টভ্রূণ যাকে জন্মাতে দেওয়া হয়নি পরিপক্ক মানব সন্তানের চামড়ায় ঢেকে-- এসব দায় তার নেই।

এমন অমোঘ সব কবিতা পংক্তিতে উজ্বল 'নীল ব্যালেরিনা'। কল্পনার যাবতীয় প্রথাসিদ্ধ আনুগত্য ফাটিয়ে নতুনভাবে কল্পনা করবার এক আকাশ যেন ছড়িয়ে যাবে চোখের সম্মুখে, বোধের সম্মুখে। অত্যন্ত ক্ল্যাসিক সেই পাঠ-অভিজ্ঞতায় বারেবারেই মনে হতে থাকবে পৃথিবীর যেকোনো ভাষার কবিতা নির্মাতাদের থেকেও অত্যন্ত শক্তিশালী বাংলা কবিতার মেদহীন সৃজন-সাক্ষর। "ঘাসের গ্যালিলি ভিজে আছে লালভ্রূণে-- ধাত্রীশুদ্রাণীর ভিড়ে / সমস্ত আকাশ জুড়ে--নীলশঙ্খে-- সূর্য দিলো ফুঁ"-- (ঊষাক্রুশ)...... "শাশ্বত জরায়ু থেকে উথলে ওঠে অঙ্কের মাতলামি : ক্রোমোসাম ! নিনেভের দুধ থেকে ছায়া ফ্যালে ওষ্ঠহননের নোনা মেঘ--তার গর্ভ থেকে ক্ষুধাতুর নীলাভ রুমাল নাড়ে পরিব্রাজকের শিঙা, শিশুর ঝঙ্কার, আর্ষ কালো অ্যাজেলিয়া;" --(প্রিয় প্লাস্টিসিন) ....... অস্তিত্বের এ কোন্ গোপন প্রকোষ্ঠ চুরমার করে কবি খুঁজে চলেছেন উৎসের আদি মেঘ, আদি রসায়ন কিম্বা ধরা যাক 'রো রো সিঁড়ি' কবিতার সেই সব অভিজ্ঞান--

ডাঁই-করা অমরত্ব অর্ঘ্য চায় কীর্তিনাশা বৃষ্টি ঝিরিঝিরি
অক্ষরের উপাসনা বৃত করে বিবিধের ক্রিয়ার শর্করা,
ভুল স্বপ্নে রতিমুগ্ধ মৃত্যুযাপনের রো রো সিঁড়ি
হুইলচেয়ারে বসে-থেকে প্রিয়তম বেঁচে থাকা বৃথা নষ্ট করা !

বলো মামন, কবির কাছে আর কিকি আশা করো, কি ভাবে সে বোঝাবে তোমাকে এই বেঁচে থাকা, কাব্য-রসায়ন সবই শুধু মুহুর্তিক যাপন-ব্যাকরণ ঘেঁটে চলা অনন্তের ধূসর আড়ালে-- ডাঁই-করা অমরত্ব অর্ঘ্য চায় কীর্তিনাশা-- আমরা ক্ষুদ্র সব সময়ের পাতা অক্ষরের উপাসনা বৃত করে বিবিধের ক্রিয়ার শর্করা-- হায় আল্লা! কি মর্মান্তিক বিষাদ কেঁপে ওঠে অস্তিত্বের অমোঘ জঠরে, কি জান্তব ভুল স্বপ্নে রতিমুগ্ধ মৃত্যুযাপন-- বেশ কিছু আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন-- "আমাদের জীবনে নেই সেই জ্বলন্ত মৃত্যু / সমুদ্র নীল মৃত্যু পলিনেশিয়ার / আফ্রিকার সিংহ হিংস্র মৃত্যু-- / আছে শুধু স্তিমিত হয়ে নিভে যাওয়া / ফ্যাকাশে রুগ্ন / তাহ সভ্যতা"-- আর অনন্য রায় সত্তরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট অনুভব করলেন-- হুইলচেয়ারে বসে-থেকে প্রিয়তম বেঁচে থাকা বৃথা নষ্ট করা-- হায় আল্লা... হহল্লা.... শুধু আসমান জমিন ফাটিয়ে, নেড়ে ঘেঁটে তছনছ কোরে, মুহুর্তের নদীতে খলবল-- দম আটকে চলেছে হল্লা হল্লা আর হল্লা-- "আমি একা, অনির্দেশ্য, দগ্ধ হই বিষাদের চুল্লির উরসে...........

                                                                তিন  

চূর্ণ করছেন নিজেকে আর চূর্ণতার ছায়ামুগ্ধ রসাতল থেকে বুদবুদ উঠছে একেকটি কবিতার নির্জন নীল ব্যালেরিনা। কোথাও সমতল নেই তাঁর কবিতায়, পারস্পরিক বস্তু সাজানোর তরঙ্গে লজিক্যাল ক্যানভাস সাজানোর ধাপ্পাকে থাবড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন গেরস্থালির ছিন্ন ছায়াপথ থেকে। শব্দের পর শব্দ জুড়ে এক বিনির্মিত দৃশ্যকল্পের জাদুতে আচ্ছন্ন আলোর ক্ষিন্ন রেখা, আত্মার উদ্ধত হুঙ্কার।  কবিতার সুরম্য দুর্গ সর্বনাশের হাওয়ায় চূরমার লাবণ্যের কেতাদুরস্ত মায়াপেখম। তথাপি স্পর্ধা নেই কোন বিজ্ঞ আলোচক এ সব লেখা কবিতা নয় বলে পাশ ফিরবে বাণিজ্য-বাদীর দুধেল বোঁটার আস্বাদে, আঘ্রাণে।  "স্ট্রবেরী-জংশন ছেড়ে কোথা ছুটে গেল নীলট্রেন ? / কেবলি জ্ঞানের স্তুপ পুঁজি করে একক শৃঙ্খলা !/ গাঢ় রাবারের কান্না ঝরে পড়ে ক্রান্তিনীল পেয়ালা-পিরিচে :/ "প্রভু, আর কত নিচে, আরো কত নিচে ?'' '' এ কোন প্রশ্ন ধ্বনিত হয় চরাচর জুড়ে, এ কোন্ কবি আমাদের সান্নিধ্য থেকে লাফিয়ে উঠছেন আকাশ গিলে ফেলা আরও এক মহাজাগতিক তন্দ্রাময়তায় যার অক্ষরের পাশে ক্লান্ত বিষণ্ন এক সময় শুধু মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পরাস্ত, বশ্যতায় অধোবদন, ছুটন্ত অগ্নিগোলকের থেকে ছিটকে ওঠা দশদিশি ধুন্ধুমার অবিরল অনিশ্চয়তার ফণায় ফণায়। অনন্য রায়ের কলমে তাই কবিতার জন্ম হয়ে ওঠে অন্যরকম।

কুমারী-কাগজ হাতে শ্রেষ্ঠ অক্ষরের লোভে যেভাবে কবিরা অহর্নিশ / বসে থাকে, বজ্রমেহ, কেবলি আকাঙ্খা করে আত্ম-তদন্তের সর্বনাশ     (কবিতার জন্ম)

এই শেষ পরিচ্ছেদটি এ লেখায় সংযুক্ত হচ্ছে শুধু কবি, সময় এবং কবিতা-কে একটা সুতোয় বেঁধে আকাশে টাঙানোর তাগিদে।  প্রথমেই দেখা যাক সত্তর দশক সময়টার গা-গতরে কোন্ আগুন দাউদাউ জ্বলছে অবিরল! সত্তর এমনই এক দশক যখন আওয়াজ উঠেছে বুর্জোয়া শিক্ষা নিপাত যাক, যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক জন্তুতে পরিণত করে-- সে শিক্ষা বা শিক্ষায়তন দুটোই ধংস করো। শিক্ষা হোক প্রয়োজনের নিরিখে।  শিক্ষা হোক বাস্তবজীবনের যাবতীয় সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিমুহুর্তে চ্যালেঞ্জ জানাবার লক্ষ্যে। আর তাই সত্তরের আগুনখেকো কিছু যুবকের দল উড়িয়ে দিতে চাইছে, জ্বালিয়ে দিতে চাইছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।  প্রকৃতির পাঠশালায় নেমে আসুক জীবন, কমিউনের মাধ্যমে নির্মিত হবে, চর্চিত হবে মেধাশক্তি। দ্বিতীয়ত, গাঢ় আলকাতরায় দেওয়ালে দেওয়ালে রাতের অন্ধকারে লেখা হয়ে চলেছে-- 'এমন দিন আসবে যেদিন বড়লোকের পিঠের চামড়া দিয়ে গরীবেরা জুতো বানাবে'। তৃতীয়ত, নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়া যাদের দায়িত্ব সেই পুলিশ বা সুরক্ষাকর্মীরাই নিরাপত্তাহীনতার চরম শিকার হয়ে নিজেদের হাতিয়ার বন্দুক সামলে রাখতে নিজেরাই কোমরে শিকল জড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হায়! কি পরিহাস সময়ের! নাগরিক জীবন স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রস্ত, বিপন্ন।  যেন চতুর্দিকে তাড়া করে ফিরছে এক অজানা ভয়। এরকমই বহুবিধ বিপন্ন সময়ের পায়ে পায়ে বেড়ে ওঠা এক মেধাবী, স্পর্শকাতর, চিন্তাশীল, পড়ুয়া এবং বিরলতম কবিপ্রতিভায় উজ্জীবিত এক কবিব্যক্তিত্ব খুঁজে যাচ্ছেন তাঁর আইডেন্টিটি।  তাঁরই কবিতায় সময়ের এক চিহ্ন উঁকি মারছে, ঝলসে উঠছে অস্থিরতার, মূল্যবোধহীনতার এক সর্বনাশ-দিগন্ত :

..........দেখেছি ফুটপাথে শুধু রক্তাক্ত শ্রমের ছকে স্বপ্ন আর মৃত্যু স্পর্শাতুর দাবা খেলে।
ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছি জামিরের বন থেকে সুইনহো স্ট্রিটের এঁদো গর্তে ;
হৃৎস্পন্দে রজার্স রোগ, চন্দ্রশেখরের গুগলি, প্রাত্যহিক হাঁপানির
                                   হলদে নাভিশ্বাস-ওঠা মৃত্যুর ছেনাল মায়ামর্ত্যে
কখনো পাইনি খোঁজ অস্তিজিজ্ঞাসার এক হোমিওপ্যাথিক ওষধির।
রক্তমাখা পুলিশ, নাপিত, বেশ্যা, পৌরস্থপতির ছেলেপুলেদের হেঁজিপেঁজি ভিড়
সঙ্ঘ-সোলারিস থেকে আমার নিভৃত স্বপ্নে ছুঁড়ে মারে আলোর বুলেট !
ইতিমধ্যে পার্টি-ভাগ, বাবা ও মায়ের ঝগড়া, রুশ-চীন বিতর্কের নোনতা ওমলেট ;
কিম্বা মনে পরে সেই পাড়াতুতো জ্যাঠামণি, যে আমাকে স্বতঃপ্রণোদিত কাছে ডেকে
আমার উপাস্য কন্ঠে রবীন্দ্র-সঙ্গীত শুনে বলেছিলো :
                                   'এমন বখাটে গান শিখলে কোত্থেকে ?'

একই কবিতার শেষ স্তবকের শেষ কয়েকটি পংক্তি কবি অনন্য রায়-কে বোঝাবুঝির দলিল হয়ে থেকে যাবে বাংলা কবিতার ইতিহাস বেয়ে তেমনই আশা রাখি :

তবুও চৌচির ছাড়া, নিজেকে নস্যাৎ ছাড়া, নিয়মতান্ত্রিক কোনো
                                                          ধিক্কার জানি না;
প্রাপ্তবয়স্কের কোনো নস্টালজিয়া নেই, আছে ভবিষ্যৎ; রক্তমাংস-বিনা !
এই তুচ্ছ বেঁচে থাকা : অপ্রাপ্তবয়স্ক ঠাট্টা-- একে আমি
                                                   আষ্টেপৃষ্ঠে সাপটে ঘেন্না করি,
এই তুচ্ছ বেঁচে থাকা : এই বেঁচে থাকাটুকু একমাত্র সুন্দর : সত্য,
                                             সাক্ষী থাকে মৃত্যুর প্রহরী !      (অপ্রাপ্তবয়স্ক)

অবশেষে আমাদেরও পাশ ফেরার সময় এসে যায় সাম্প্রতিক সময়ে নোঙর ফেলবার তাগিদে আর তাই তাড়াহুড়ো ফিরে আসার আয়োজনেও দেখি অনন্য অনন্য হয়েই আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে কবিতার প্রস্ফুটিত নান্দনিক মুকুল যার সৌরভ ব্যতীত বাংলা কবিতা কোনদিনই সাবালক হতে পারবে না বলেই মনে হয় --

..........এভাবে অভ্যাসমুগ্ধ মৃত্যুযাপনের থেকে চাই রূপান্তর :
আমার যা-কিছু নেই তারই জন্যে মোহগ্রস্ত আমি পূজা করবো প্রিয়
                                                           অজানার ক্ষত
অক্ষরের মেঘাবৃত সৌরউরসের ঘুমে উঁকি মারবে অনন্য ঈশ্বর --      (টারান্টেলা)


Facebook Comments


Google Comments