15 June, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

kobi

রমিত দে |প্রণব চক্রবর্তী | অমিতাভ মৈত্র |মাণিক সাহা |সব্যসাচী সান্যাল |জপমালা ঘোষরায় |রবীন্দ্র গুহ |ইন্দ্রজিৎ দত্ত |পীযূষকান্তি বিশ্বাস |সোনালী মিত্র |নীলাব্জ চক্রবর্তী |সুবীর সরকার |রাধে ঘোষ |রিমি দে |পায়েলী ধর |শমীক ষান্নিগ্রাহী |কুমারেশ তেওয়ারী |ফারাহ্ সাঈদ |শুভ আঢ্য | অগ্নি রায় |দীপঙ্কর দত্ত

রমিত দে


অক্ষয় মালবেরি : এ শট ফিল্ম অ্যাবাউট মেমোরী

না, এ ফিল্মের কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়। ওরা নড়ে চড়ে কথা বলে হাসে কাঁদে এমনকি কখনও সখনও সন্দেহ করে নিজেদেরকেই আর ক্রমাগত একে অন্যকে ধাক্কা দিতে থাকে মানে একে অন্যকে তার থাকার কথাগুলি জানাতে থাকে অথচ তারা তো নেই; তারা তো কয়েকটা স্থির শব্দমাত্র তবে তাদের চলমানতা লক্ষ্য করি কিভাবে! তাদের মস্তিষ্ককোষ তাদের রক্তক্ষরণ তাদের পুরোনো প্রদাহের প্রতিটা প্রকোপ দেখতে পাই কি করে ! আসলে এই ছোটো ছোটো সিকোয়েন্স বা শাব্দিক ফ্রেমগুলো কেবল কিছু ঝাপসা প্রতিচ্ছবি মাত্র, তাদের চলমান করতে ওদের সামনের ওদেরই মাপের একটা ফুটো বা এপারচার খুলে রাখা হয়েছে, এর ভেতর দিয়ে আলো যায় আর ওই এপারচারের মুখে একটার পর একটা ফ্রেম একটার পর একটা শব্দ ডানা ঝাপটাতে থাকে আর আলো পেয়ে নতুন গতির অভিজ্ঞতা লাভ করে। ওই এপারচারটা আসলে স্মৃতি আর তার ওপর ফেলে আসা এক সারি  স্থিরচিত্রকে ক্রমাগত ঘুরিয়ে চলেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত নামের এক মহৎ দ্রষ্টা, যিনি তাঁর এই ব্যক্তিগত প্রদর্শনীগৃহে প্রবেশের আগেই কিভাবে যেন জেনে গেছেন ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক জগতের মনটিকে। ওই এপারচারটার মধ্যে আলো পড়ছে আর সবকিছু অচেনার মধ্যেও দর্শকমন যেন অবিরল চলেছে কোনো চেনা স্রোতের ভেতরে, ওপারে কি একটা জায়গা খুঁজছে তারা, একটা নিজস্ব অঞ্চল, যেখানে ঐ আলো ফেলা লোকটা, ওই অভিনেতা, তার কলাকুশলী তার ইউনিটের লোকজন এবং দর্শক সবাই সবাইকে শেষমেশ জড়িয়ে ধরবে কোমলভাবে, ক্লান্তিহীনভাবে। মাঝে মাঝে সময়ের শাটার এসে আলোর পথ আটকে ধরছে আর সেই অল্প মুর্হুত পর্দায় কেবল অন্ধকার। আমরা এভাবেই একটা মানুষকে দেখছি, আলোয় একটা মানুষকে দেখছি ছায়ায় একটা মানুষকে দেখছি, আমরা এভাবেই বাস্তব থেকে গল্প হওয়া দেখছি, স্মৃতি থেকে স্বপ্নের অংশীদার হয়ে পড়ছি আর লক্ষ্য করছি এক অনন্ত জাদুকর কিভাবে কখন তাঁর নিজেরই অজান্তে সাহিত্যের ন্যারেটিভে আঘাত হেনে দিয়েছেন চিত্রপরিচালনার নান্দনিক অভিঘাত দিয়ে। হ্যাঁ, যে মুর্হুতে ‘অক্ষয় মালবেরি’র মত আত্মজীবনীর প্রসঙ্গ আসে সে মুর্হুতেই শব্দের অক্ষরের পাশাপাশি উঠে আসে দেখার এবং তার যথার্থ প্রতিরূপ রচনার আকর্ষণীয় সমীকরণটিও। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে পরিচালকের দৃষ্টি আসলে ক্যামেরার সাহায্যে বাস্তবায়িত করা হয় আর আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দেখা স্মৃতির হাত ধরে শিল্পরূপ লাভ করে। এখন যেহেতু অধিকাংশ ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টির কৌণিক বিস্তার একশো আশি ডিগ্রীর চেয়ে কম, তাই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় শিল্পী তাঁর নির্বাচিত অংশটুকুই দেখাতে পারেন সেখানে। কিন্ত মণীন্দ্র গুপ্ত ‘অক্ষয় মালবেরি’ তে কেবল একজন স্টোরিটেলার বা অটোবায়োগ্রাফিকাল ইন্টারপ্রেটারের কাজ করেননি যে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক তাঁর সীমায়িত দৃশ্যে বা সীমায়িত ভাবপটে জারিত হবে বরং তিনি যেন অনেকটা স্মৃতি সঞ্চালক হয়ে গুটিসুটি ঢুকে পড়ছেন পাঠকের নিজেরই অঞ্চলে। কেবল তাঁর নিজের প্রতিবিম্বের সামনে নিজেকে মেলে ধরা অথবা পাঠককে কেবল অভিজ্ঞতার বহুমুখী দ্যোতনায় আমোদ দেওয়ার বাইরে তাঁর প্রতিচ্ছবি তাঁর স্মৃতি দ্বারা অধিকৃত জায়গায় পাঠককেই স্থাপিত করেছেন, আর এই হল মণীন্দ্র গুপ্তের দেখা, যা আসলে স্মৃতির পর্দায় অন্য জনের চোখ স্পর্শ করছে এমনভাবে যেখানে মনে হচ্ছে তিনি যেন নিজের চোখকেই স্পর্শ করছেন আবার উলটো দিকে মণীন্দ্রের এই সারিবদ্ধ স্মৃতির পর্দায় পাঠক খুঁজে নিচ্ছে তার নিজস্ব স্বাধীনতার সূচক যা তাকে মূল চরিত্রগুলোর সাথে জুড়ে যেতে সাহায্য করছে এবং মূল চরিত্রগুলোর আয়তন ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আমাদের বিরাট সাদা বাড়ী আমাদের অসংখ্য ঘুপচি ঘর নিয়ে বারান্দা সিঁড়ি চিলেকোঠা বেয়ে অনায়াসে উঠে আসছি আর পৌঁছে যাচ্ছি মণীন্দ্রের ব্যক্তিগত স্মৃতির খোলা ছাদে। ক্যামেরার সাহায্যে বাস্তবকে ব্যাখা করা যেমন সিনেমার লক্ষ্য, দৃশ্য থেকে দর্শকের দূরত্ব কমিয়ে আনা যেমন তার অভিপ্রায় ঠিক তেমনি 'অক্ষয় মালবেরি' এমনই এক গোপন আশ্রয়, যেখানে একজন  লেখকের চেনা স্মৃতির সাথে একজন পাঠকের অজ্ঞাত জগতের আপাত দূরত্ব কমিয়ে আনার খেলা চলছে, তারা একে অপরের ফ্রেমে চলাফেরা করছে যার ফলে গড়ে উঠছে প্রত্যাশা, মিশে যাবার, ডালপালা মেলে একে অপরে আচ্ছন্ন ও সন্মোহিত হবার প্রত্যাশা।  
  
স্মৃতি সর্বস্ব মানুষ আমরা, ''মানুষী স্মৃতিই মানুষ। স্মৃতিই জটিলতা।'' মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজীবনীমূলক আখ্যান 'অক্ষয় মালবেরিতে' এই স্মৃতিকেই পুনরায় পাঁচ আঙুলে ধরে বেঁধে আমরা গড়িয়ে দিই একটি অলিখিত আয়ুর দিকে আর সে হাঁটু মুড়ে উঠে বসে। আর এভাবেই স্মৃতি হারিয়ে দিল সময়কে। থামিয়ে দিল ঢালু পথে গড়িয়ে যাওয়া নুড়ি পাথরকে। কোন ডাকে সাড়া দিয়ে সে একদিন দাওয়া থেকে উঠোনে নামল! উঠোন থেকে গাছের কাছে, গাছ থেকে বনের মধ্যে, বন থেকে পুকুরপাড়ে আর পুকুরপার ঘুরে মাটির রাস্তা ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে খালের পাড়ে গিয়ে আটকে পড়ল ? আটকে পড়ল, নাকি চৈ চৈ চৈ চৈ চৈ করে মানুষের জন্য খুলে দিল মানুষের ঘরবাড়ি, খুলে দিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর বিদঘুটে দৌড়বার শব্দ। আর মণীন্দ্র গুপ্তের স্মৃতিকাতর মানচিত্রে আমরা নিজেরাই ঢুকে পড়লাম নিজেরই অলখে, পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম নিজেদেরকে।  হ্যাঁ, মণীন্দ্র গুপ্তের পুঁতে রাখা ‘অক্ষয়’ মালবেরি’র তলাতেই আমরা বসেছি। স্মৃতির জল ঝরে পড়ছে, ওই যে দ্যাখো না স্মৃতি আর আমি কেমন পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালাচ্ছি, মটরলতার বনে শুঁটি ছাড়াচ্ছি, কেমন পাকা গাবের ভরাট ব্যক্তিত্বের ভয়ে নেমে আসছি টনটনে এবড়োখেবড়ো ঘুমের বাগানে আর ঘুমিয়ে পড়ছি। ‘রিপ ভ্যান উইংকলের’ মত ঘুমিয়ে পড়ছি। না আমরা ভাবছি না এখন বাড়ি ফিরব কি করে, আমাদের নাম ধরে ডাকাডাকিও করছে না কেউ, শরীর ভয়ে ভারী হয়ে যাচ্ছে না কিংবা লন্ঠন হাতে নিয়ে কেউ উদ্ধারও করছে না। আসলে স্মৃতিকে যে মণীন্দ্র গুপ্ত রেখে গেছেন আমাদের আপন শোণিতে; টোবাটোবা হয়ে, নৈকট্য আর প্রার্থণা হয়ে, সবুজের মধ্যে লাল হয়ে এক নিরাশ্রয় পথিকের যে ওটুকুই নিশ্চিতি ওটুকুই নিরাপত্তা ওটুকুই নির্ভরতা। ঠিক এ জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ বাঁধে, কেন এই মালবেরির বাঁধন হতে পালানোর তাগিদ পাচ্ছি না ? কেন সিমুলেট হচ্ছি বারবার ভেতরের দিকে ! আমার তো শূন্য হাতে ফেরার ছিল, তবু কেন আমি ওই মালবেরি গাছের ঝরে যাওয়া বাকল আর পাতা কুড়োচ্ছি ? কোন অর্ধস্ফূট বিছানা পাতব বলে ? কেন তিনখানা কাঁচা বাঁশ এসে রাত্তিরবেলা আমার দরজা আটকে দাঁড়াচ্ছে ? একটি অক্ষয় মালবেরি, যার পূর্ণজন্মকাল অবধি জানা নেই যার সরনী চেনা নেই তারই বধিরতা ভেদ করে কেন ডুবে যেতে থাকে আমার, আমাদের একজোড়া করতল ! এই সেই বিমূর্ত যোগাযোগ যার জন্যে মণীন্দ্র গুপ্তের কাছে আমাদের ঋণ থেকে গেল, ঋণ থেকে গেল এক সরল অক্ষয় মালবেরির কাছে। মানুষ যতদিন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখবে যতদিন পর্যন্ত দূরাময়তা তাকে ব্যথা দেবে, বিস্ময় দেবে, পৃথিবী নামের এই মহাবিদ্যালয়ে যতদিন পর্যন্ত সে খুঁজে বেড়াবে হারিয়ে যাওয়া একটি স্বপ্ন লেখা খাতা, যতদিন পর্যন্ত সে ঋতু কিনতে চাইবে, ডানা লাগাতে চাইবে শরীরের দুপাশে ততদিন অবধিই এই দৃশ্যকে ঘিরে ঘিরে আমাদের গল্প ...

দুশো বাষট্টি পাতার অখন্ড আত্মজীবনীর শেষে এসে আমাদের প্রাপ্তি পথিকসত্তায় জারিত এক প্রব্রাজক। যিনি স্বপ্নকে স্মৃতি থেকে তুলে ছুঁড়ে দিলেন সাধকের দেশে। আর হিম ছোরার মত বিঁধে গেল পাঁচটি প্রাণ, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, আর চারটি অন্তঃকরণ। এ কি কেবল আত্মজীবনী? কিছু অন্যমনস্ক অনুভবতা, স্মৃতির কিছু শট কম্পোজিশন ? নাকি জীবনের গীতলকাব্যটিকে স্নেহের পরিধি থেকে ছিন্নমূলের আর্তনাদ অবধি পারস্পরিক যুক্ত ও সমৃদ্ধ কোনো এক ক্যামেরাকোণ থেকে দেখা ! এ আত্মজীবনীর প্রধান রংকে কোনো একটি ভাষা দিয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় বরং কেন্দ্রচ্যুত উল্কার মত একটি বড় সত্তায় মিশে যেতে যেতে কয়েকটি খন্ডসত্তার আবেশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন মণীন্দ্র, যা শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হতে হতেও রূপাতীত শূন্যতায় পৌঁছোচ্ছেনা বরং একধরনের আবেশ একধরনের সুষুপ্তির নকশা ট্রাকিং শট নিয়ে চলেছে অস্তি নামের এক আবহমান অনন্তের। 'অক্ষয় মালবেরি'’র সারা শরীরে মাখামাখি হয়ে আছে দৃশ্যের গতির সাথে মনের গতির এই মিথস্ক্রিয়াই। একদিকে যেমন মণীন্দ্র গুপ্তের এ আত্মজীবনী এক সংসারনিভৃত সাধআহ্লাদের ছবি যেখানে ব্লিস অফ এক্সিজটেন্সের নির্ভেজাল চালচিত্র সেখানেই পাশাপাশি চেতনার কিছু অনবদ্য উচ্চারণ কিছু গভীর বর্ণলিপি বর্তমান; মোহ ও মননের এই পারস্পরিক সাম্যরসই নাটকীয় কাঠামো দিয়েছে 'অক্ষয় মালবেরি'র সার্বিক কালার স্কেলে। স্মৃতিযাপনার প্লট জুড়ে যেমন স্মৃতির ভেতর পড়ে থাকা স্মৃতিলেখাকে তাদের নিপুন স্বাভাবিকতায় অনুলিখিত করেছেন মণীন্দ্র তেমনি আত্মচেতনার বৃত্তি থেকে বিচিত্র সব ফাঁক বেয়ে উঠে আসছে একধরনের ক্রিয়েটিভ জিওগ্রাফি, একধরনের বৈশ্বানর আত্মা। এই বৈশ্বানর আসলে সেই জাগরিত স্থান যা স্থূল বিষয়, উপভোগের বিষয়, এবং জাগ্রত অবস্থার বাইরের এক বাহ্য জগত, যাকে শৈশব থেকেই জারিত করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। শৈশব হতেই পাঁচ আঙুলে জড়ো করেছেন এসমস্ত স্পর্শের কথা-সেখানে কেবল স্মৃতি বা সত্তার বোধই নয় বরং অস্তি থেকে বেরিয়ে আসছে আরও কিছু অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগত, সম্ভূতির আলো, গতি ছন্দের মত লীট মোটিফগুলোর থেকে প্রতিভাত হচ্ছে অসম্ভূতির কিছু গাঢ় শেড। স্মৃতি থেকে তিনি যখন আত্মজীবনী লিখছেন, তখন তাঁর পৃথিবী কেবল বর্তুলাকারই নয় বরং কিছুটা ছড়ানো, শৈশবের ইথার তরঙ্গে আক্রান্ত। আগাগোড়া প্রায় সমস্ত আত্মজীবনী জুড়ে তিনি তাঁর নায়ক তিনি তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক অতীত তাঁর সম্প্রসারিত আদুরেপনা। প্রৌঢ় জীবনীকার একে একে তুলে আনছেন সেই প্রাগৌতিহাসিক শীতলতা অথবা 'স্বপ্নের পৌরাণিক ও শৈশব উপাদান'। জীবন তো এক গোছা রূপান্তরের সাক্ষী শুধু, গঠনের গতিপ্রকৃতির মাঝে অগঠনের কয়েকটা কালো তিল রোপনের খেলা। অনির্বাণ প্রশ্নমালাকে জাগাতে জাগাতে এই চর্চিত সূর্যালোকের দেশে তারা রচনা করে যায় সূর্যাস্তসমগ্র। তবু জলে ডোবা ঘাটের পৈঠায় লেগে থাকে নিথর শামুকেরা, আলো পিছলে যায়, একলা দাওয়ায় বসে থাকে অন্ধকার, শীতে কাঁপতে কাঁপতে চাদর সোয়েটার টেনে মায়াবাদে নেমে আসে মানচিত্রহহীন এক দেশ। আত্মজীবনীর কোথাও অফুরন্ত স্বাধীনতার এই মণীন্দ্রকে আমরা পাই,- ‘খাইদাই পাখিটি, বনের দিকে আঁখিটি’ বলে যিনি নিজেকে অতিজীবিত করে তোলেন বারবার। অপবৃক্ষদের দেখতে দেখতে, ভূতের কুয়াশাদের দেখতে দেখতে, ইহলৌকিক নৌকাগুলির দূরে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে, যিনি প্রশ্রয় দেন ভারহীন জীবনকে, দৌড়ে বেড়ান স্ফূর্তিময় আবর্তনের দিকে, মেদহীন ছিপছিপে বোধিসত্ত্ব জীবনই যার জন্মান্তর, যার ধারণায় ব্যক্ত হয়ে ওঠে হালকা, বাহুল্যবর্জিত উপকরণহীন হয়ে বেঁচে থাকার গল্প। তাঁর আত্মজীবনীকে কোথাও ইন্ট্রোস্পেকশন বা আত্মদর্শন বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে যেখানে নিজেরই অজান্তে মণীন্দ্র গুপ্ত নিজেকে তুলে দিয়েছেন দক্ষ কোনো মনঃসমীক্ষকের হাতে। অতীত ও ভবিষ্যতের মেট্রিক মনতাজের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁর স্থাবর মাটির ভিতটিকে, সাত রঙের ছোটাছুটিটিকে। মেঘ এসে সেখানে যেমন ঢেকে দিয়েছে শৈশবের রোদ-বোরখা, ঠিক তেমনি অন্তরঙ্গ বন্ধুবৃষ্টিটিও কখনও ধুয়ে রেখেছে ধূসর স্মৃতির শরীর; মণীন্দ্র গুপ্তের সে সব কল্পনায় আলো ফেললেই উঠে আসে স্বপ্নের পশ্চাৎ ভ্রমণ, শৈশবের হ্যালুইসিনেটরি সংঘাত। সেখানে ঠিক কত রং আছে কতটা আদিসুগন্ধ –মণীন্দ্র গুপ্ত যেন জানতে চেয়েছেন তার সবটুকু, পাটকাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছেন শৈশব উৎসের দিকে, শিশুপুরাণের দিকে। শৈশবের স্মৃতি প্রসঙ্গে ফ্রয়েড বলতেন- ''শৈশবের প্রথম কয়েকটি বছর যে বিস্মৃতিতে ঢাকা থাকে, দেখা যাবে তার ভিতর থেকে কিছু স্পষ্ট স্মৃতিও উঠে আসছে। অধিকাংশ দৃশ্যচিত্রের চেহারায়, যা বজায় থাকার যথেষ্ট কোনো কারণ নেই। স্মৃতি পরবর্তীকালের বিপুলসংখ্যক স্মৃতিমুদ্রণ কিংবা স্মৃতিচিত্রগুলিকে একটি বাছাই প্রক্রিয়ার সাহায্যে সংরক্ষিত করে। যা গুরুত্বপূর্ণ তাকে রেখে বাদবাকি খারিজ করে দেয়। কিন্তু শৈশবস্মৃতির ক্ষেত্রে একথা খাটে না। শৈশবস্মৃতিতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলি প্রতিফলিত হয় না। এমনকি শিশুর দিক থেকে নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ এরকম অভিজ্ঞতাও নয়, বরং বেশিরভাগ সময়ই সেইসব যা এতই বৈচিত্র্যহীন এবং অর্থহীন যে আমরা শুধু অবাক হয়ে নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, ঐসব বিশেষ খুঁটিনাটি আদৌ মনে থাকল কেন? আপাতদৃষ্টিতে উলটো বলে মনে হলেও শিশু কিন্তু বয়স্কদের মতোই স্মৃতিতে তাই ধরে রাখে যা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ তার পুনরুপস্থাপনা ঘটে স্মৃতিতে যা আপাত গুরুত্বহীন তারই উপস্থাপনায় (সংক্ষেপন বা condensation এবং স্থানচ্যুতি বা displacement প্রক্রিয়ার সাহায্যে)। এ কারণে শৈশব স্মৃতিগুলোকে আমি বলি বাছাই স্মৃতি বা screen memories। এদের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদের ভিতর থেকে সেসবই উঠে আসছে যা বিস্মৃত হয়েছিল।'' ‘অক্ষয় মালবেরি’-র সর্বত্র্য ছড়ানো ছিটানো এমনই সব স্ক্রিন-মেমোরিজ। খুবই সাদামাটা খুবই সাধারণ অথচ অন্যলোকের, অপর আবহাওয়ার। এই ছোটো ছোটো বিস্মৃতিগুলো নিছক বাক্য হয়ে ওঠেনি বরং যেকোনো পাঠকের কাছে তা কল্পনায় পৌঁছে যাবার রাস্তা। প্রাচীন দ্বীপের মত ডুবে গিয়েও যেন জেগে আছে আজও। একজন পাঠককে মণীন্দ্র গুপ্ত শব্দের মাধ্যমে দৃশ্যটির সাথে বা ইমেজগুলির সাথে যেভাবে পরিচিত করিয়েছেন এসব সাদামাটা আটপৌরে সহজের সাথে তাতে পাঠক লেখকের ক্যামেরার আই লেভেলে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেছেন অনায়াসে। এসব ‘বাছাই স্মৃতি’র গভীরে গা ডুবিয়ে বসে থাকে কেবল বাল্য বা শৈশব নয় বরং মণীন্দ্র গুপ্তের সার্বিক যাপনের এক সাংকেতিক ভাষা এক সিঁড়িভাঙা সময়পঞ্জিকা। এবং কেবল মণীন্দ্র গুপ্ত কেন, এসব ইমেজের সাথে লেগে রয়েছে বিভিন্ন মাপের মানুষের বিবিধ সমবায়, বিবিধ ওঠানামা, ফলে পাঠক একটি আত্মজীবনীর থিসিসে নিজেকেই সিনথেসিস করতে পেরেছেন অনায়াসে। এজাতীয় কয়েকটা ‘বাছাই স্মৃতি’ বা স্ক্রিন মেমোরিজের কাছে আমরা ফিরে ফিরে আসি যেন আমাদেরই ‘পূর্বকালের দু একটা কথা’ শুনতে কিংবা তলাতলহীন মণীন্দ্রীয় আকাশটাকে দেখতে-

১-সাদা কাগজের ফিতে-লেসের বিছানায় বিস্কুটেরা অতি আদরে খুকিপুতুলের মতো শুয়ে আছে। এইসব শখের খাবার উপহার পেয়ে নিজেকেও হঠাৎ কাঁচকড়ার পুতুলের মতো লাগত।

২-ছোটোমাসি চমৎকার মেয়ে……টাইফয়েডে মারা গেল…অনেক কাল পরে, ভুলে যাওয়া বাতিল জিনিসের আস্তানায় একটা স্টিল ট্র্যাংকের মধ্যে আমি তার লম্বা চুলের গোছা এবং গানের খাতা আবিষ্কার করলাম। শুকনো চুলের গোছা হাতে নিয়ে স্তম্ভিত আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম: ছোটমাসি দৌড়ে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে-তার দীর্ঘ দীর্ঘ চুলের প্রান্ত এখনও উড়ছে ইহলোকে। ইহজগৎও স্থির, মাঝখানে শুধু আমিই কাঁপি।

৩- শালিকরা যত না ধান খেত তার চেয়ে ঝগড়া করত বেশি। আমার ডালিম গাছের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ত, ‘ডালিম গাছে পিরভু নাচে’। পিরভু কি রকম ? সে কি পাখির মতো কেউ ? হলদে রং গা ?

৪- ছোটমা স্নান করে এসে উনুনের কাঠে আগুন দিয়েছে……অদৃশ্য ফোকর দিয়ে কাঁচা কাঠের ধোঁয়া……প্রথম সূর্যকিরণের গায়ে জড়িয়ে ধোঁয়াদের কত রকম আঁকাবাঁকা সর্পিল ভঙ্গিমা। কখনো তারা অসম্ভব সুন্দর কলকা হয়ে এঁকেবেঁকে ওঠে, কখনো ডিমের কলি থেকে জেগে পেখম মেলে, কখনো ডোরাকাটা ছায়ার কোলে শুয়ে শিশুর মতো আঁকুবাঁকু করে-পরীর ঘাগরা, মৎস্যভঙ্গি, মায়াবী ঝালর, মাথার মধ্যে ঘুমের কুয়াশাদৃশ্য, আরো কত কি !

এই শিশুকেই এই শৈশবকেই আচমকা ধরে ফেলে মোটাসোটা বেঁটে একটা চৌকাঠ, সে পেরোতে চায়, শরীর ডিঙিয়ে মাথা ডিঙিয়ে 'টলতে টলতে দাঁড়ায় পড়তে পড়তে হাঁটে’ আর ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে দিতে চায় জলস্থলঅন্তরীক্ষের সহজ সমীকরণ। এবং যথারীতি ডোরাকাটা হেঁয়ালির মত হারিয়ে যায় কোনো এক দূরতম ঊর্মির খোঁজে। অথচ ভেতরে ভেতরে কোথাও কি রয়ে যায় ডেরা বাঁধার ধীর এক হামাগুড়ি ? অবসেশন উইথ দ্য ইমেজ অফ এ হোম ! বারবার বাস্তুহারা মণীন্দ্রের আত্মজীবনীতেও তাই আমরা লক্ষ্য করতে পারি এক ধরনের প্রথম স্তরের মাটির আলেখ্য, তাঁর রহস্যালোকও মেখে থাকে অতীতের ঘন কাদা। ‘অক্ষয় মালবেরি’তে জীবন বিষয়ক রাগ অভিমান সুখ দুঃখ আনন্দ আশা ভরসার রস জড়ো করলেও কোথাও যেন স্নান সেরে মাথায় গামছা বেঁধে বসে থাকা ছবির মত কেবল একটি ঘর যার একদিকে অনন্ত জীবনের রোদ লেগে থাকে আর পথ পেরিয়ে তাকে ফেলে এলেও বারবার পথের পরাজয় হয় সেখানেই, মণীন্দ্র গুপ্ত বারবার ধূসর প্রেতের মত ফিরে আসতে চেয়েছেন শৈশবের ওই ঘরে। সে ঘর কেবল মাটির নয়, সে ঘর মাখামাখি পৃথিবীর, সে একটা পথের জীবন, পা বাড়ানো বনভূমি সে এক। আত্মজীবনীর মহাপটে তাই স্মৃতিতর্পিত প্রৌঢ়প্রাণে ফিরে ফিরে এসেছে ভরহীন নিষেধাজ্ঞা মুক্ত এই ছেলেবেলা, মাটির কাছাকাছি মিহি মোলায়েম হয়ে থাকা আর সেখানে দাঁড়িয়েই মণীন্দ্রের কাছে বাস্তুকলা অর্থে- ''ঘর যদি মাটির হয় তো তৈজসও হবে মাটির। প্রাণ চলে যাবার পর শরীর পঞ্চভূতে যেমন ভেঙে যেতে থাকে, আবাসিক চলে যাবার পর গৃহও তেমনি লয় পাবে''। ফ্রয়েডের ‘আনক্যানি’র মত ঘুরে ফিরে এসেছে মণীন্দ্র গুপ্তের ভিটেমাটি সম্পর্কীয় মেমোরি সিকোয়েন্স, কোথাও কোথাও প্রোটাগনিস্ট হয়ে উঠেছে মাটি, মুখ্য চরিত্রে কখনও কখনও সালংকারা হয়ে উঠেছে জলে ভিজিয়ে রাখা শুক্লপক্ষের কাঁচা জ্যোৎস্নাটি, কখনও কখনও পৃথিবীর কাছাকাছি অগনণ লাল ফড়িং-এর ওড়াই হয়ে উঠেছে ‘অবলোকিতেশ্বরের আলো’ আবার কখনও বা স্রেফ উত্তর গোলার্ধে, তেইশ ডিগ্রী অক্ষাংশের তিন মাইল উত্তরে আর নব্বই ডিগ্রি পূর্বদ্রাঘিমার নয় মাইল পুবের বিশেষ কাটাকুটিতে বেঁচে থাকার জন্য দুটি মানুষের নিশ্চুপ বসে থাকাতেই প্রতিভাসিত হয়ে উঠেছে জীবনের বীজরূপটি। এ যেন অচিন বিশ্বলোকের মাঝে কয়েকটি নিঝুম নিকেতন তৈরী করার প্রেষণা! আর এভাবেই ফিলোজোফিকাল ডায়ালগ বা এসটোরিক সিম্বলজিমের বাইরে সাবজেক্ট ও অবজেক্টের মাঝের বেড়া ভেঙে ফেলাই হল ‘অক্ষয় মালবেরি’র ভিস্যুয়াল লিটারেচার। ঘর এবং ঘরহারার, স্মৃতি ও স্থাপনের মাঝের অ্যামবিগুইটিই হয়ে উঠেছে তাঁর শৈল্পিক নৈঃশব্দতা, শৈল্পিক নবান্ন। যা একাধারে কাব্যিক অন্যদিকে জীবন্ত। আবহমান থেকে আশ্চর্য ফুল তুলতে তুলতে যা ভেসে গেছে অনিশ্চিতির গল্পে। ‘পৃথিবী যেন সাবানের বুদবুদ’- আর সেখান থেকেই চিরআয়ূষ্মানের ব্যাকরণ খুঁজে চলেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। ''হেঁটে কি লাভ! তার চেয়ে বাড়ি ফেরা ভালো''। একদিকে তিনি পরিব্রাজক আবার অন্য দিকে রাত বাড়লেই চুঁইয়ে নামছে জড়সড় স্বর, চুঁইয়ে নামছে অন্যের শরীর নিয়ে ভেসে বেড়াবার নির্বোধ ক্লান্তি। ঠিকানায় ঠিকানায় দীর্ঘ হয়ে উঠছে ''ভুল বাড়িতে কেন এলাম?'' জাতীয় প্রশ্ন। প্রতিটা ভ্রমণের শেষে ঘিরে ধরছে ভূমিহারার এমনই এক অতলান্ত ভ্রম আর তাকে ঘিরে ঘিরেই পোড়ো ভিটেগুলিতে মানুষের ছেড়ে যাওয়া রুগ্ন তৃণজীবনগুলিতে খুঁজে ফিরছেন সরু পৃথিবী অথবা নীরব সুড়ঙ্গের মত কিছু অক্ষয় ওষুধ।

একটা ছায়ানাটক বা শ্যাডো থিয়েটারে ঠিক যা যা থাকা সম্ভব মাঝে মাঝে মনে হয় ‘অক্ষয় মালবেরি’ সেই ছায়ার জ্যা ধরেই একটি জীবন্ত মানুষের নান্দনিক ভাষ্য খুঁজে চলেছে। কি থাকে তাঁর ছবিতে ? স্থায়ী ছায়া নিয়ে কোন দুর্বোধ্য আলোর সাথে কথা বলেন তিনি ? ভীষণ ফাঁপরে পড়ি যখন নিজেকেই এ জাতীয় সরল প্রশ্নের মুখোমুখি করি। একটা নিঃশব্দ পথিকসত্তায় একটা দোহাট খোলা দরজা ছাড়া আর কিই বা থাকবে ? কিন্তু এই একটা দরজা দিয়েই তাঁর অতীত আর বর্তমানের যাতায়াত শুরু, প্রতিদ্বন্দ্বীতা শুরু, সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণ শুরু। এই একটা দরজা দিয়েই তিনি বাস্তবের সাথে যেমন মিলিত হচ্ছেন তেমনি অভিঘাত হচ্ছে অতীতের সাথে। আর যাপনের একাধিক ইমেজ একে অপরকে ওভারল্যাপ করে যাচ্ছে। আমরা পাচ্ছি কিছু অপসারী রেখা যার শেষে ঠিকানা লেখা আছে যার শেষে ঠিকানা লেখা নেই। আর এখানেই সেই অদ্ভুত সমন্বয় ও সংশ্লেষ, এখানেই সেই মাড়িয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটার বিগ ক্লোজ আপ। তিনি কি পুনর্গঠন চাইছেন নাকি প্রিটেনশন করছেন হারিয়ে যাওয়া রাস্তাটা হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো চিরভ্রাম্যমানতায় কোথাও না কোথাও আছে। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অনন্তকালের লতাজাল হয়ে আছে। দিকচিহ্নহীন বিলের মাঝে হারিয়ে গেল যে আঁধার রাত, অথবা কাদায় ঘুমন্ত প্রাণের অবোধ পিপাসা রেখে উড়ে গেল যে কয়েকটা চঞ্চল কাদাখোঁচা তাকে তিনি খারিজ করতে পারছেন না কিছুতেই, কেন ? চাইছেন না তার সঙ্গহীনতা! এক বিপন্ন বিস্ময় থেকে স্মৃতি নামক ছইয়ের নিচে মণীন্দ্র গুপ্ত সেই একা মল্লার যিনি ফিরে যাবার কথা উঠলেই নিজেই নিজের বয়াকে দুলিয়ে দিচ্ছেন। নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর এই অভ্যেস থেকেই হয়ত স্মৃতিকে তালিম দিয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত, ''পৌরাণিক আদরের মধ্যে'' ভূমিষ্ঠ হওয়া মণীন্দ্র গুপ্ত, আদিম সবুজ বিষ রক্তে মিশিয়ে নেওয়া মণীন্দ্র গুপ্ত জন্মের মত ব্যবহার করেছেন স্মৃতিকে। তাই তো শেকড় ছিঁড়ে গিয়ে, জীবনের ধূসর শুকনো উড়ো বাতাসে উড়ে গিয়ে যে মানুষটা রোগ পুষে সারারাত শুয়ে ছিল বাস্তবের বিশাল বড় দৈত্যের হাতের তালুতে সেই যেন বার্ধ্যকের দরজায় দাঁড়িয়েও দেখতে চাইল ফেরার পরম অবস্থানভূমিটিকে, প্রজননের সেই ধৃকেন্দ্র যেখান থেকে কুবো পাখির কুব কুব কুব আর শঙ্খচিলের টি টি টি টি-ই ডাক কল্পনার ঐশীতে তীব্রতর করে দিয়ে যায় দূর শূন্যের কোনো এক ‘পুরুষ বাতাসে’র পৃথিবীর কাছে পুনঃপুনঃ ফিরে ফিরে আসার গল্প দিয়ে। এই হল মণীন্দ্র গুপ্তের যৌথ অবচেতন, কালেকটিভ আনকনশাস যা সর্বতোভাবে প্রকৃতিরই প্রকাশিত জগত, পার্থিবের স্পষ্টতায় দাঁড়িয়ে অপার্থিবের মূক নিকটতা। তারই হলুদ কৃষিক্ষেত্রে ফুলে উঠছে তাঁর স্বপ্নের ফোলা পেট, ছায়ার খোঁজে গভীর বনে ঢোকা তাঁর জীবনের অর্বুদ সংখ্যারা। জীবন থেকেই তুলে আনা জায়মান ফোঁটাগুলো এক কিশোরকে -যুবককে -প্রৌঢ়কে কাঠখড় চিতার ভেতর দিয়ে টেনে আনছে তারাবন কোলে নেওয়া শৈশব বন্দী এক শিশুর দুপুরে। ফলে তাঁর আত্মজীবনী কেবল স্মৃতির পূর্ণতা বা পথ চলার প্রসেস নয় বরং ‘লেন্স অফ এক্সপেরিয়েন্স’ কে তিনি দৃশ্যক্রমের সীমা ছাড়িয়ে বারবার ‘লেন্স অফ এক্সজিসটিং’-এ প্রতিস্থাপিত করেছেন আর বারবার এই ইমেজ প্রতিস্থাপনের মধ্যে দিয়ে মালটিপল ইমপালস পেয়েছে মানুষ ও জীবনের কথা । কিশোর বয়সের মণীন্দ্র বা যুবক মণীন্দ্রের ভাষ্যতেও তাই বাস্তবতার একটা বড় অংশের ছবির পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই শৈশবের কাল্পনিক আয়তন, আবার অতীত আশ্রিত এই আয়তন পুরোমাত্রায় চেতনানির্মাণও নয়, বরং তার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে একটি ভাঙা সময়ের সুখ দুখ আশা ভরসা রাগ অভিমান। 'অক্ষয় মালবেরি' র সবটুকু জুড়েই কোথাও যেন এই শৈশবের শূন্য একটা লড়াই, সরল হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো একজন শিশুর অদৃশ্য উপস্থিতি, আর লিন্ডা অ্যান্ডারসনের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ এবং দার্শনিক লাঁকার কিছু সিদ্ধান্তের মিশেলে তার যে সম্ভাব্য অর্থ অনূদিত হয় তা হল- ''A child only arrives at a  sense of selfhood when it sees itself reflected as a whole in a mirror for the first time, in what is known as the mirror stage. It recognises this whole as something it wants to be, but because the child’s own perception of the self does not provide this sense of unity in identity from this moment onwards it has to look to significant others and society as a whole to act as mirrors that reflect back a unified image of the self. The unified self, then, is always only a fantasy, a mirror image, towards which the subject continually strives and the other is always implicated in the subject’s sense of self, because the subject will look to others to ratify his or her identity''। অ্যানিমোনের মত যে পরজীবী শিশুকে বাঁশের চোঁচ দিয়ে ইঙ্গিতময় দ্বৈত পৃথিবীর সারসংকলনে আনা হয়েছিল গৈলা গ্রামে, সেই শিশুও তার টলটলে স্মৃতির মাঝে পুঁতে নিয়েছে ইন্দ্রিয়জগতের এমনই সব ট্রাইট্রেশন। কোথাও যেন হামা দিয়ে দিয়ে হাঁটতে চাননি মণীন্দ্র গুপ্ত বস্তুপুঞ্জের অস্থির নিয়মের মাঝে। কেবল একটা মজার আয়নার সামনে কোনো ম্যাজিশিয়ন তাঁকে ক্রমশ নিয়ে চলেছে সেই ডিম ফোটাবার প্রথম খেলায়, নিয়ে চলেছে গুপ্ত এক আমোদচক্রে। তিনি ঢুকতে চাইছেন অর্ধেক ইঁট আর অর্ধেক বাঁশের বাইরের সেই প্রাকৃতিক হাওয়াবাতাসের জগতে যার চারদিকে সমস্তই অসম্পূর্ণ কিংবা এক অতীন্দ্রীয় মধুমাখানো, যেন এক ধরনের চটচটে মহাশূন্য। ছায়ানৌকো নিয়ে নামতে চেয়েছেন, অমনোযোগী শ্রাবণে দেখতে চেয়েছেন আশ্চর্য সেই ঘনতা -পরম ডেনসিটি। ‘জনমানুষ ও বনমানুষের’ মধ্যবর্তী ফাঁকটুকুতে ফিরে যাবার এ যেন তাঁর কনশাস এফোর্ট, ঠিক যেভাবে মাটির নিচের বিরাট লোহার সিন্দুক থেকে শৈশবের কোনো যখ বেরোতে চেয়েছে পুরোনো রামের গন্ধে। শৈশব থেকেই তিনি কোথাও একা নন, কিছু ফ্র্যাগমেন্টেড সেলফ তাঁর সাথে সাথে একীভূত হয়ে রয়েছে, আবার পাশাপাশি স্মৃতির অ্যালবাম খুলতে খুলতেই তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন কোনো সমাধিস্ত আকৃতিতে কোনো অজ্ঞাত গভীরে। স্মৃতিবীজ বা আঁতুড় অভিজ্ঞতাতেই সংক্রমিত হতে চেয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। এক্ষেত্রে স্মৃতির সমবায়ী আড়ষ্টতায় মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার প্রসংগে কবি প্রাবন্ধিক রঞ্জিত সিংহের ‘মায়া আর নির্মায়ায় তার মুখখানি” প্রবন্ধের কিছু অংশ খুবই প্রাসঙ্গিক-“মায়া নির্মায়ার প্রান্তরেখায় কোনো শীতরাতে মাঠে শুয়ে সে এখন ভাবে পশু থেকে যোদ্ধা, যোদ্ধা থেকে মহাপুরুষ হতে তারাদের ক' কোটি বছর লেগেছে। বিজ্ঞানচক্ষু বৃদ্ধের মতো  উপলব্ধি করতে পারে সে- জড় চেতন, বস্তু-প্রাণী নির্বিশেষে একটিই সত্ত্বা। শুধু পরিবর্তনশীল। সেই আদিম সত্ত্বাই 'এই মালভূমি, এই তুষারপাত, এই আকাশ, এই তারা।' এবং এই-ই বোধ হয় বোধিসত্ত্বের জীবন। ফলে শরতের মেঘ বা কাশফুলের চেয়ে বেশি ভারী কোনো কিছুর সঙ্গে সে আর জড়িয়ে পড়তে চায় না। আজকের এই মহীরুহের বীজ তো ছেলেবেলাকার মটরশুঁটি লতার রহস্যের মধ্যেই ছিল ! পরিণত মানুষটি এবারে বুঝে ফেলেছে তার জীবনরহস্য- ''ছেলেবেলা থেকে ভেবেছি উপকরণহীন জীবন আর পূর্ণ আত্মনির্ভরতার কথা।'' এই ভাবনাটাই বোধহয় একসময় নিজেকে একটা টাইম মেশিন হিসেবে ভাবতে সাহায্য করে। ঐ মেশিন যেন আমাদের জন্মজন্মান্তরের নিয়ামক। তার চলৎশক্তিতে গ্রীষ্মবর্ষাশরৎহেমন্ত সাঁট সাঁট করে মিলিয়ে যেতে থাকে। জীবনচক্রের রহস্য উন্মোচিত হয়ে দেখাচ্ছে, কেমন করে সে একদিন আট-পা মাকড়সা ছিল, হল ছয়-পা পিঁপড়ে, তারপর দু-পা মানুষ, আবার অন্তিমে লীন গোলাকার ডিমে-প্রজননের ব্যাকুলতায় অধৈর্য, অস্থির। এই সেই মায়া নির্মায়ার জগৎবাসী-যে বলে সে বায়সজাতীয়। 'অক্ষয় মালবেরি’র পরতে পরতে এমনই এক ডানাওয়ালা মানুষ, যার উড়নযাত্রায় থেমে থাকার তর্ক চলছে খুব, ধুলো দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে ‘দেহবদ্ধ আয়তন’, স্মৃতির আলো থেকে বেরিয়ে আসা নোনা লম্বা ছায়াগুলো অতিক্রম করতে চাইছেনা নিজেদেরকে অথচ একই সাথে তাঁর প্রতিটি চলা অতিক্রম করতে চাইছে নিজেকেই, নতুন অন্বেষণের উদ্যোগ নিচ্ছে।

অনুভবের ক্যামেরা নিয়ে 'অক্ষয় মালবেরি'’র প্রায় সর্বত্রই নিজেকেই তাড়া করে ফিরেছেন মণীন্দ্র, স্থান কালের মধ্যবর্তী ছেদ ভরাট করতে বারবার অতীতের চৌকাঠ পেরিয়ে উঠে এসেছেন বর্তমানের কাছে কিন্তু বারবার ক্যামেরা জুম করে ফিরে গেছে ভিতরের একটি ভাষার কাছে আর ক্লোজ আপে উঠে এসেছে প্রথমের সেই অন্তরঙ্গ গুঞ্জন। শব্দের চারিপাশে এত শব্দ এত কোলাহল অথচ তাঁর শাব্দিক কোরিওগ্র্যাফিতে আমরা পেয়েছি স্মৃতির ফেলে আসা একটি ঘরের পোকায় কুরে খাওয়ার শব্দ। ঘরের প্রতি কি চরম অবশেসন! নিরীহ এক ফালি জমির প্রতি! তাঁর নিজের কথায়- ''সবকিছু দেখে শুনে মনে হয়, মাটিতে জন্মে, শুধু মাটিটুকুই অবলম্বন করে আমাদের খুশি থাকা উচিত। সেই শ্রেয় পথ। একটা নতুন সভ্যতা কি গড়া যায় না যেখানে মাটির তৈজসপত্র, কর্দমস্থাপত্য, মেটে রাস্তা-যেখানে মানুষ চাইলে কুড়ানী হয়েও বেঁচে থাকতে পারে। সে দেশে অন্ন বাজারে থাকবে না, গোলায় থাকবে না, আড়তে থাকবে না, থাকবে মাঠে, জলাশয়ের কিনারায়, বনে, পাহাড়ে, যেখানে তার জন্মস্থান সেইখানে। নিতে হলে সেইখান থেকেই তাকে নিতে হবে।'' দ্ব্যর্থকতার মাঝেই আরও একটি সম্পূরক পরিবেশ তুলে রাখছেন আত্মজীবনীর অংশ করে। সেখানে ভাষাহীনতা জুড়ে ভরাট মাটির গল্প। এক বিচ্ছেদ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কিনারার বাসিন্দার ফিরে আসার এই আকুতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির কয়েকটা ছবিকে। 'মিরর' ছবিতে আমরা দেখছি গ্রামের যে বাড়িতে বড় হয়েছিলেন তিনি হুবহু সেই বাড়ির মত সেট বানিয়েছিলেন, অর্থাৎ কেবল একটা নিছক পরিসর বানানোই সেখানে প্রকল্প নয় বরং ছবি ধরে ধরে এক নিপুন চোরাস্রোতের মোহে জড়িয়ে যাওয়াই ছিল পরিচালকের উদ্দেশ্য। এই বিপ্রতীপতা সৃষ্টি করা আসলে অভিবাসন থেকে অস্তিত্বের দিকে গড়িয়ে আসারই সুপ্ত আকাঙ্খা। আবার ‘নস্টালজিয়া’ ছবিতে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে আসছে শৈশবের বাড়ির দৃশ্য স্মৃতির দৃশ্য, সে বাড়ির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ এ লেগে আছে যাপনের গূঢ় সংকেত। বাড়ি যেন মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজীবনীতেও একটা বেস ইমেজ, একটা যাওয়া আর ফিরে আসার রসায়নে লীন হয়ে আছে সে। অ্যালিয়েনেট হতে হতে বারবার ফিরে আসছেন বাড়ির স্বপ্নিল ছবির দিকেই। আসলে মাটির প্রতি এই টান হয়ত কিছুটা হলেও মেন্টাল এসকেপ, যদিও প্রাচীনে ফেরার এই পদ্ধতি সহজ নয় তবুও কোথাও মণীন্দ্র গুপ্ত মহলের পর মহল পেরিয়ে যাচ্ছেন কেবল এক স্প্যাশিয়াল ডিসকনট্যিনিউটিকে মেলাবার তাগিদে। একটা তরল যোগাযোগ যার মাঝখানে স্মৃতির সংজ্ঞা খুঁজছেন মণীন্দ্র গুপ্ত, আকার খোঁজার চেষ্টা করছেন। সেলফ ও সাবকনশাসের ভেতর যে ডিজহারমনি তাতেই কাঁচি চালাচ্ছেন এডিটর মনীন্দ্র, একটা সেট একটা লোকেশন খুঁজ়ে চলেছেন অতীতকে বানানোর জন্য, তার স্মৃতি তার স্বপ্ন নিয়ে বিরোধাভাসের অসমীকরণের দিকেই তাঁর অ্যাওয়েটিং ভয়েজ। নিজের অবয়বকে খুঁজে পেতে আইডেনটিটিকে চিনতে ছায়া পড়ে আসা গুপ্তঘরগুলোই হয়ে উঠছে কনভিনিয়েন্ট মেটাফর। আশ্চর্যভাবে অখন্ড ‘অক্ষয় মালবেরির’ প্রচ্ছদও মণীন্দ্র গুপ্তের নিজের হাতে করা এবং সেখানে ঘন সবুজের ভেতর কালো রঙের এলোমেলো গাছের ছায়ায় সবুজ রঙে কবির নাম ক্রমশ হারিয়ে গেছে। প্রচ্ছদেও কি গাছের আবছা অন্ধকারে নদী বিল হাওড় হয়ে পৃথিবীর ফেলে আসা কোনো আদিভূমিতেই জলরং-এর লয়গুলিকে জড়ো করতে চাইলেন! এত রঙের বহুবিধ মিশ্রণের মাঝেও পেতে চাইলেন অপ্রকাশিত বিলয়ের শুদ্ধ রঙটিকে ! এ যেন একটা অবসোলেট রুটকে চাগিয়ে তোলার ইচ্ছে, যুক্তিকাঠামোর বাইরে কেবল নস্টালজিয়া থেকে ঢুকে পড়া বাড়ির ছবিতে। এই পর্যটনই তাঁর কোর ডেজায়ার। ‘অক্ষয় মালবেরি’র স্বাতন্ত্র্যের জায়গা। শুধু একটু বাতাসের জন্য শুধু একটু ভেতরের টানের জন্য শুধু একটু চলমানতার জন্যই বারবার কথকের চক্কর কাটা গার্হস্থ্যআবহের কাছে। সারা জীবনের ঘনিষ্ঠতার শেষে একদিকে যেমন তিনি বলছেন- “হঠাৎ অন্ধকার ফেটে গেলে-ভেতরে টান দিচ্ছে সিঁদুরে মেঘ/হৃদপিন্ডের মধ্যে তোড়ে ঢুকছে শুকনো বালি/হৃদয়ের কল্লোল শেষে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল-/একটু বাতাস !/বিরাট একটা পিঁপড়ে তার লক্ষ লক্ষ ডিম পায়ে দলে/আর্ত রাক্ষসের মতো বেঁকে যাচ্ছে শূন্যে- /শুধু একটু বাতাসের জন্য/শুধু একটু বাতাসের জন্য”, ঠিক তেমনিই শূন্য থেকে ফিরে আসছেন ‘মায়া ও নির্মায়ায় মাখা এক কুয়াশাচ্ছন্ন পার্থিবে; পাতা ঝড়িয়ে ফেলেও গাছ যেন ফিরে আসছে শেকড়ের শাসনকে মেনে, শীতের মাসগুলোকে মেনেও আগুন হয়ে উঠছে ঘনিষ্টতম, এমনই অন্বয়দ্বয়ের মধ্যে দিয়ে সামগ্রিকতায় পৌঁছোতে চেয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। বাড়ীর কাছে বাস্তুবিদ্যার কাছে নিঃসংগ এসকিমো পাখির মত ভাসা কাঠের কাছে তাই কি তাঁর লগ্নতা, আর্তি !-

            ………''আমি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান করে দেব,
          নিজে দেখাশোনা করে বানিয়ে দেব।
          গোনাগুনতি খোলা সিঁড়ি ছাদে উঠে গেছে ..., এমনভাবে যেন শিশুরা
          মনে করবে তারা আকাশে উঠছে। বাজপাখি দুপুর-মৌতাতে
          পাহাড়চূড়া ভেবে জলের ট্যাংকে এসে বসবে। আবার ঝড়ের মধ্যে
          মনে হবে, কংক্রিটের এক বেঁটে পালোয়ান  চার হাত পায়ে
          উবু হয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী কিছুতেই তাকে চিত
          করতে পারছে না ।'' ………

কখনও কখনও মনে হয় মণীন্দ্র গুপ্ত যেন তার ক্রিউ আর কেরিয়ার নিয়ে একটা চিত্রপরিচালকের জায়গা দখল করে বসেছেন। কেন্দ্রে নিজেকে রেখে তার ভেতর দিয়েই মানুষকে ভ্রামণিক করে তুলছেন, আত্মজৈবনিক উপাখ্যানের প্রোটাগনিস্টকে ক্রমশ আনক্যানি নস্টালজিয়াতে নস্টালজিক করে তুলছেন,  ‘অক্ষয় মালবেরির’ ফাইনাল শটেও কি অনন্ত এক উচ্ছেদের ভেতর ফেলে আসা সেই সমান্তরাল আর একা হয়ে যাওয়া রংভর্তি ক্যানভাসটাই ধরা পড়ল না? ''ট্রেন পূবের দিকে ছুটেছে- মানে ভোর হবার আগেই ভোরের মধ্যে ঢুকছে। ট্রেনে লম্বা রাতের শেষে ভোরে উঠে তেষ্টা পেয়েছে… সারা রাত হাওয়ার ঝাপটা লেগে লেগে শীতল হয়ে আছে জল…… কিন্তু আমি ছিপি খুলেই চমকে উঠলাম। চলকে ওঠা রামের গন্ধে কামরাটা ভরে গেল। জলের বদলে লোকটা রাম ভরে দিয়েছে। কেন ?- ভালোবেসে ? মজা করার জন্য ? লোকটা কি গোপন মেফিস্টফিলিস, না কি ছদ্মবেশী ব্যাকাস!......কলকাতায় ফিরে, ধোবার পরেও, বোতলটাতে বহুদিন রামের গন্ধ লেগে ছিল। আমার ভালো লাগত। একটা দূরে রেখে আসা জীবনের কথা মনে পড়ত।''- এই কি সেই ফ্রস্টের মেফিস্টফিলিস ! বিপুল জাঁকজমকের মাঝে, যন্ত্রণা আর বিযুক্তির মাঝে যার আত্মা বিক্রিত হয়ে আছে আর স্মৃতিকে উসকে দিয়ে যিনি ফিরে গেছেন কয়েকটা স্বীকারোক্তির গল্পে! দূর কয়েকটা গল্পে কয়েকটা গন্ধে নির্বাসিত এক আত্মাকে দিয়ে গেছেন স্মৃতি নামের ছাপাখানা।

কিন্তু স্মৃতি কি ! কোথায়ই বা থাকে সে ? যদি এ প্রশ্ন করা হয় তবে স্বপ্নের অংকে প্রাপ্তি বলতে কেবল একটি সমীকরণহীন ফানুস, অজস্র পেরিয়ে অভিজ্ঞতা পেরিয়ে যার কেবল মুর্হুমুর্হু অবতরণের ধুম। অথচ তার কাছে বাতাস যে অবয়বহীন, চলমান, সে যে বারবার রূপঅরূপ থেকে খুঁজে পেতে চায় হারিয়ে যাওয়া সেই অমোঘকে ! সে জানে তার পালক কত হালকা অথচ বারবার হেরে বসে মানুষ আর মাটি ছোঁওয়া পাখির আকারে। আত্মকথার কাছে এলেই বারবার মনে হয় এ যেন স্মৃতির সাথে সাক্ষাৎকার। কিছু ভাঙা কথপোকথন ! কুচি হয়ে যাওয়া কেবল কিছু কথা ! নাকি অতি গহন এক  যোগাযোগ ? যে ক্রমশ স্মৃতিকে নিয়ে চলেছে কাঁচা শরীরের মধ্য দিয়ে ঘোলাটে ঘরবাড়ি দেখাবে বলে। দেখাবে কীভাবে স্রোতের মধ্যে পড়ে গেল আবছা কুয়াশাভরা জন্মান্তর। একা, অস্বাভাবিক একা, একটি জীবন কেমন করে জন্মনক্ষত্র থেকে ছুঁড়ে দিল আরও এক জটিল জীবনেরর দিকে; এবং আবার সে একা। এই পশুপালন এই প্রণালী এই বিবিধ রঙের অনন্তের অভেদ বুঝে ওঠার বহু আগেই স্মৃতি আসলে এমনই একা, কেবল স্মরণের দরজাটা ভেজিয়ে কাঁচাপাকা চুলে বসে আছে বিলি কাটছে, আমাদের জেগে থাকাকে বারবার নির্বাসনে পাঠাচ্ছে আর বলছে –“You have wakened not out of sleep, but into a prior dream, and that dream lies within another, and so on, to infinity, which is the number of grains of sand. The path that you are to take is endless, and you will die before you have truly awakened.”।

আত্মকথা বা আত্মজীবনীর কাছে এলেই আমরা দেখি প্রায় সবটুকুই ফেনোমেনোলজিক্যালি রিচ কিছু অতীত স্মৃতি, যা ছিল যা হারায় নি, অসম্পূর্ণতার বেদনা নিয়ে অথবা আনন্দের নিরুপম নিয়ে তা সবটুকুই আমার হয়ে আছে, হ্যাঁ, 'আমি', একটা বড় হাতের 'আমি' একটা ফার্স্ট পার্সেন মেমোরি কোথাও যেন আত্মজীবনীর গায়ে সবসময়ই লেগে রয়েছে চুন সুপুরি খয়ের নিয়ে। সচরাচর ফার্স্ট পার্সেন নলেজের লজিকাল কানেকশনেই গড়ে উঠেছে আত্মজীবনী। অনেকটা ইউনিটি অফ দ্য সেলফ ইন মেমোরি এবং অবশ্যই তা রিমেমবারড মেমোরি, অভিজ্ঞতাজাত স্মৃতি। আর ঠিক এ জায়গা থেকেই মণীন্দ্র গুপ্তের স্মৃতিচারণার স্বকীয়তা আমাদের টেনে আনে এক সজীব দরজার দিকে যেখানে আত্মস্থ স্তব্ধতা সরিয়ে রিডার্স পার্টিসিপেশনের সনির্বন্ধ অনুরোধ উঠে আসে, উঠে আসে একটা প্লুরাল ক্যারেকটার অফ মেমোরির কথা; যার অন্তিম দৃশ্যে চূড়ান্ত মুক্তিকামী কোনো এক মানুষকে ফিরতে বলছে মাটি, সীমারেখা ভেঙে দিতে বলছে। একজন মানুষ যে কিনা প্রবহমানতার পটভূমিতে বারবার সঙ্গহীন হচ্ছে সেই স্মৃতি আর সত্ত্বার মাঝে জিইয়ে রাখছে সজীব এক সিম্বলিক কনট্যিনুয়াস। যেন কিছু ফ্লাশব্যাক কিছু কাইনেটিক মেমোরি আর তার মাঝে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোকে যোগ করে করে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা খুঁজছেন। বীজের কাছেই পড়ে থাকছে তাঁর তৃষ্ণা তাঁর তাড়না তাঁর স্তব্ধতার পৃথিবী। ইকোস অফ নস্টালজিয়াই হয়ে উঠছে তাঁর সাবকনশাস স্ট্রাগল। যেখানে পথ তাঁকে বলছে, এসো, মাথাভর্তি জীবন নিয়ে এসো এই গোল পৃথিবীর দিকে সেখানেই ঘর বলছে, থেকে যাও, প্রথম প্রতিমার গায়ে এক কণা বালি হয়ে, শোলার সাজ হয়ে রঙীন রাংতা হয়ে কিংবা কেবল মাত্র এবড়োখেবড়ো মাটি হয়েই থেকে যাও। এবং তাঁর এই আয়োজনের সঙ্গী হচ্ছি আমরাও। আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারণ যে যাপন যে টানাপোড়েনের কথা তিনি বলেছেন, থাকা না-থাকার যে ভূমিখন্ডে দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে ‘অক্ষয় মালবেরি’ সেই বিচ্যুতির ব্লুপ্রিন্টে যে আমরাও সামিল আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলি যে সেখানেই নিগেট করছে – মনে হচ্ছে একজন লেখকের স্মৃতিতাড়িত ডায়ালেকটিক্সে জড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে পাঠকের ম্যাট্রিক্স, লেখক পাঠক একই সাথে যেন উচ্চারণ করে চলেছেন বোধ ও বহতার কয়েক পংক্তি-

                     “I am forever walking upon these shores,
                    Between the sand and the foam,
                  The high tide will erase my foot-prints,
                 And the wind will blow away the foam.
               But the sea and the shore will remain
             Forever ….” (Kahlil Gibran)

‘অক্ষয় মালবেরির’ পুরো ছবিটাকে আমরা একটু পজ দিয়ে স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড করি।  আস্তে আস্তে জেগে ওঠার আগে গল্পের পুরো বাড়িটাকেই আবার ঘুম পাড়ানো হোক, ঘুম ফিরে যাক তার জ্ঞাতিবর্গের কাছে জাতিস্মরতা নিয়ে। দেখা যাবে মণীন্দ্র গুপ্ত আসলে শুরুর দিকে যাচ্ছেন, অতিপরিচিতের দিকে যাচ্ছেন অপরিচিতের মধ্যে দিয়ে, তাঁর পরিযায়ী ডানা জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে কেবল মানুষের জেগে ওঠার দৃশ্য দেখার জন্য নয় বরং ঘুমের মধ্যে ছেড়ে আসা জীবনের মুহ্যমান পাপড়িগুলোকে দেখবার জন্যেও। এ এক নতুন ভোকাবুলারি, নৈঃশব্দের নব ভাষাতত্ত্ব-আর্কিটেকচার অফ সলিটিউড। বালকের ঘুমের মধ্যে খুলে রাখা এক অনন্ত বেলুনের জ্যামিতি-এই হচ্ছে ‘অক্ষয় মালবেরি’। সেখানে নিরঞ্জন আঁধার, আবার সেখানেই একটুকরো রোদ্দুর প্রজাপতি হয়ে ওড়ে, সেখানে দরজা ঠেললেই পেরিয়ে যাওয়া যায় মহলের পর মহল। আর্দশ পরিণামবাদীর ন্যায় জৈবলোকের সার্বিক প্রকার সন্ধানের থেকেও কোথাও কল্পলোকেই তাঁর ‘অবিভাজ্য অমোঘ সংগঠনের লগ্নতা’। মাঝে মাঝে যা মনে হয় তাঁর স্বগক্তোতি তাই আবার ধীর ধীরে হয়ে ওঠে একটি সংঘবদ্ধ সখ্যতা। একটা ক্রুড পেডান্টিক যাপনের পুনরুদ্ধারই তাঁর পর্যটন, সেই তাঁর ‘শরতমেঘ’ সেই তাঁর ‘কাশফুলের বন্ধু’ সেই তাঁর নির্বিকার খালি পায়ের জীবনদর্শন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে মণীন্দ্র গুপ্ত কখনও অস্বীকার করতে চাননি কিন্তু তা থেকে উত্তরণও চেয়েছেন আর এখানেই তাঁর এক নিজস্ব অদ্বৈতবাদ, পথিকসত্ত্বা ধরে ধরে ‘পুরুষ বাতাস’ ধরে ধরে কোথাও যেন খুঁড়ে এনেছেন উৎসমুখ, যেখানে প্রতিটা শব্দই তাঁর ব্যক্তিগত অথচ প্রতিটা শব্দই সমষ্টির ধ্বনি ধরে আছে। এই আকাশ এই নক্ষত্র এই মায়া নির্মায়ার পৃথিবীর খাল বিল নদীর ম্যাপ তাকে নিয়ে চলেছে নির্বিকল্প কৈবল্যের দিকে। তার ভেতর নিহিত আছে আরও এক নিরাবয়ব পুরুষ। কোথাও যেন আত্মার প্রয়োজনে আত্মজীবনীর কাছে নিরাকার হয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। অনাস্বাদেয় মায়াবাদকেই তাঁর উপনিষদীয় স্পর্শে দিয়েছেন একধরনের অব্যক্ত ব্যাকুল। গল্পের শরীর থেকে বিন্যাস থেকে অবয়বহীন বর্ণপরিচয়ে উঠে এসেছে হাই ডেনসিটি একটা কোর্য়াক সমুদ্র একটা ‘আমি’ সত্ত্বা, আবার সেই সত্ত্বাই গান্ধর্ব অন্ধকারে গলে গলে আদিকথার সুর ও বুদবুদে ভেসে ভেসে পরিণত হয়েছে দীর্ঘকালীন ‘আমরা’য়, যেন নীরবের ভেতরেই আমরা কোলাহল গুনছি আর প্রতিটা শব্দ প্রতিটা স্বপ্ন হয়ে উঠছে মহিম সময়ের আশ্চর্য মায়াডোর। সম্পূর্ণ অজান্তে, সংগোপনে, নাকি জেনে বুঝেই বহু জন্মের গর্ভাবাসের দিকে পূর্বপুরুষের দিকে মণীন্দ্র গুপ্তের এমন অস্থিত অনুসরণ ! তার আলিঙ্গনের কথা হাহাকারের কথা কী বোধাতীত বিশুদ্ধের প্রয়োজনেই ? ‘অক্ষয় মালবেরি’ এর প্রথম পর্ব তিনি উৎসর্গ করেন স্ত্রী দেবারতিকে, দ্বিতীয় পর্ব পার্থপ্রিয় বসু ও কুশল গুপ্তকে এবং আশ্চর্যভাবে তৃতীয় ও শেষ খন্ডের স্মরণ দাদামশায় বিমলাচরণ সেনগুপ্ত ও দিদিমা সুবোধবালা সেনগুপ্তকে, আবার তাঁর প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থ ‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু' উৎসর্গীত ‘কাকা বাবা দাদু ও পূর্বপুরুষের’ উদ্দেশে। আসলে তাঁর অভিপ্সায় তাঁর অনিবার্যতায় তাঁর আনুগত্যে শেষমেশ সমর্থিত হয়ে উঠছে ঝরে ঝরে যাওয়া এককগুলো, কালপ্রবাহগুলো। তাঁর নিজের কথাতেই ''কালপ্রবাহ এক অদ্ভুত জোড়া শব্দ। কোনোদিন এই নশ্বর তেতলার ছোট্ট বারান্দায় বসে দূরের সান্ধ্য লাল মেঘ দেখতে দেখতে সাময়িক বোধিলাভ হয়। ভাবি, কাল বলে কিছু নেই। আছে শুধু প্রবাহ। সর্বপ্রকার অস্তিত্ব নিজধর্মেই রূপান্তর পায়। এই তো চোখের সামনে দেখছি, সবাই সবাইকে পালটে দেয় সূর্যডোবা আলো মেঘকে পালটে দিয়েছে, লাল মেঘ বিকেলকে পালটে দিল, বিকেলের ব্রহ্মান্ড আমাকে পালটে দিচ্ছে। সবাই সবাইকে পালটে দিচ্ছে। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার মতো। সবাই মিলে উৎসবে মাতবার মতো।'' -মণীন্দ্র গুপ্তের এই উৎসব সুষুপ্ত আত্মার উৎসব, কোনো আয়াস নেই সবই আনন্দময় আর এই আনন্দ আসলে স্বরূপের আনন্দ। এমনতর মহীরূহেই তো মণীন্দ্র বাঁধতে চেয়েছেন তাঁর পার্থিব হিঞ্চের দাম আর কাঁটায় আকীর্ণ পশ্চিমপুকুরটি। বিচিত্র জগতের মাঝের বিলয় স্থানটুকু বিশেষরূপে জানতে চেয়েছেন, বৈশ্বানর বা প্রাজ্ঞ হিসেবে নিজেকে জাহির নয় বরং অনুভব করতে চেয়েছেন কেবল অনুভবটুকু আর এই খোঁজ এই অস্থিতি বারবার তাঁকে নিয়ে গেছে নির্বিকল্পে, তুরীয় নিরপেক্ষে। বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপের মনোহরনে মণীন্দ্র গুপ্তের সমর্পণ বোঝাতে খুব ছোট্ট একটা অংশ এমুহুর্তেই মনে পড়ছে- “দক্ষিণে রেইন ট্রি গাছটি নেই- বাড়ির সবচেয়ে বিশাল স্তব্ধতা আর হালকা পাতার তিরতির কাঁপন আর গভীর অস্তিত্ব অতখানি জায়গা ফাঁকা করে চুপচাপ চলে গেছে। তার গুঁড়িতে বাকলের ফাটলের ডেয়ো পিঁপড়ে আর সাধারণ খুদে পিঁপড়ে চলাফেরা করত। আমি পুকুরপাড়ে বসে কল্পনা করি। আমরা যেমন কৈলাস-মানসসরোবরে যাই তেমনি হয়তো এক অভিযাত্রী খুদে পিঁপড়ে একদিন শেকড় থেকে হেঁটে হেঁটে মগডালের দিকে তীর্থযাত্রা করেছিল। একেবারে ডগায় পৌঁছতে হয়তো তার মাসখানেক লেগেছিল। উঠে কিন্তু সে সত্যিই দেখতে পেল; মানসসরোবর- আঃ। কত বড় নীল হ্রদের মতো আকাশ ! তার শুঙ্গে এসে লাগছে হ্রদের শীতল হালকা জলকণা, রে দূরে আবছা কৈলাসের মতো সুদূর মেঘ। তার জন্ম সার্থক'' -একে কী বলা যেতে পারে- ম্যাজিক রিয়ালিজম? নাকি অক্ষর সহযোগে আত্মাকে ওংকারে পরিণত করা ? জাগরিতস্থান থেকেই মণীন্দ্র গুপ্ত কান পাতছেন নিরাভরণ নতুন জাগার দিকে, সংসারে থেকেই হয়ে পড়ছেন সঙ্গীহীন, একাকী। তাঁর আত্মজীবনীর শেষে পড়ে থাকে একটা ব্ল্যাঙ্ক ভার্স যেখানে আমাদের মত ভাঙাচোরা মানুষেরা আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই, একটা ছোঁয়ার আর্তি, না থাকার এক বিশ্বাসী বোঝাপড়া অথবা থাকার এক দার্শনিক ডিগিং। যন্ত্রজীবনের নাগরিক স্মার্টনেস নয় বরং পাশাপাশি দুটো নিরাভরণ খাট পেতে মণীন্দ্র গুপ্ত ও তাঁর পাঠকের ঘুম ভাঙছে বত্রিশ জাতের পাখির ডাকে। যে ‘চৈতন্যের পৌনঃপুনিক আক্রমণে’ তিনি কবিতার ভাষা তৈরীর কথা বলেছেন সেই চৈতন্যই তাঁর আত্মজীবনীর আলোবাতাস, সেই চৈতন্যতেই কোথাও নিজেকে ছুঁতে চাওয়ার অন্তর্লীন যোগসূত্র লুকিয়ে আছে। তাঁর আত্মানুসন্ধান কোনো গাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসা নয় বরং তারাকাঁটা আর জংলাঝোপে ভরা বেশ বড়সড় একটা সারল্যের মাঝ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আনন্দের ফুল তোলা, সে ফুল তুলতেও কষ্ট তাই পাতার আড়ালে রাখা থাকে সন্ন্যাস, কবির সে সব প্রার্থিত কল্পনা সে সব কোলাহলহীন প্রলম্বিত থাকা, সেখানে পাখির চোখে এতটুকু স্যাঁতসেঁতে ভাব নেই সেখানে বাড়ি ঘাস টিলা সবকিছুই শীতের মিষ্টি রোদে পেকে মিষ্টি হয়ে আছে, ডুবে গিয়েও শুঁড় ভাসিয়ে রেখেছে শীতের ভোর আর নদীর কুয়াশা- সব কিছুই সঞ্চয় সেখানে আর এই সঞ্চয়ই মণীন্দ্র গুপ্তের জীবনের সম্পূর্ণ গোটা একটা আয়, আত্মজীবনীর সম্পূর্ণ গোটা একটা খরচ। প্রকৃতির নগ্নতা গ্রহণ করেছেন তিনি, তাঁর আখ্যান পড়ে আছে সেসব অস্তিত্বের কাছে যারা এখনও বেড়ে চলেছে সফরসঙ্গী হয়ে। আজ এবং কালকের মাঝে একা পড়ে আছে তাঁর অতীত বাস্তুভিটে, উপচে আছে অনাবিল সম্ভাবনা আর সেখান থেকেই মণীন্দ্র গুপ্ত  বলতে চাইছেন- “I slipped out of myself and surrendered to you” । স্মৃতিকথায় অভিজ্ঞতা থেকে অংশগ্রহণ করছে তাঁর জীবন। সেখানে চরিত্র কে ? মণীন্দ্র গুপ্ত! তাঁর গৈলা গ্রাম ? আখাউড়া, কুলাউড়া, লাকশাম ? চাঁদপুর, মাছিমপুর ? নাকি  পাঠক ? নাকি বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভিজে ওঠা কিছু জীবনের মন্থন ! বয়ঃসন্ধি থেকে বেড়া টপকে যাওয়া চলমান টুপগুলো ! এক উত্তরণ পর্বে দাঁড়িয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত যেন সকালের আলো ফেলছেন বিকেলের রোদে অথবা যাপনের বন্ধনী থেকে একে একে খুলে ফেলছেন প্রাচীন সব পারমুটেশন। এমন এক অলীক সংগ্রাহক যিনি কাছের দূরের চেনা জগৎ আর রূপকল্প থেকে গ্রহণ করছেন অনিরূদ্ধ কল্পনা। ‘মুক্ত পুরুষ’ মণীন্দ্র মহাদ্রুমের মত ‘বিশল্যকরণীর সবুজ রসে কাঁচের ধমনী’ ভিজিয়ে খুঁজ়ে চলেছেন সেই মৌলিক ‘পুরুষ গন্ধ’ যা আক্ষরিক অর্থেই একক, অনাস্বাদিত এবং অবস্থানের মধ্যে আকস্মিকের পথ দেখাচ্ছে, ওড়বার সূত্র চেনাচ্ছে আর কোথাও যেন বেজে উঠছে জন্মলোকের ঘণ্টা আর পাঠককে নিয়ে ইন্দ্রিয়নির্ভর থেকে ইন্দ্রিয়াতীতে চলেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত - অন্তঃরঙ্গ স্বরূপের খোঁজে।

মাঝে মাঝে মনে হয় 'অক্ষয় মালবেরি'র এ ভাষা কার ? একজন কবির ? গদ্যকারের নাকি আত্মজীবনীকারের ? নাকি একজন চিত্রশিল্পীর ? আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে লেগে থাকা ভাষার এই উদ্ভট লুকোচুরি এই দ্বৈত চরিত্রের কথা রবীন্দ্রনাথকেও আমরা বলতে শুনি তাঁর জীবনস্মৃতির শুরুতেই। “স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়। এইরূপে জীবনের বাইরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে। দুয়ের মধ্যে যোগ আছে অথচ দুই ঠিক এক নহে।'' মণীন্দ্র গুপ্তও কি এভাবেই তাঁর স্মৃতির ভরা সংসার থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে এঁকে চলেছেন এক পরম মনোগ্রাহী ছবি ! একজন আত্মজীবনীকার যে মুহুর্তে তাঁর ফেলে আসা শৈশবের মেঝেতে তারার দেশের, কিন্নরলোকের আর প্রেতলোকের রং আবিষ্কার করেন, যে মুহুর্তে স্রেফ মেঝের রং নয় তিনি তো পাঁচ আঙুলে মাটির নকশা এঁকে ফেলেছেন, ভরাট করে ফেলেছেন বাইরের আর ভেতরের ফাঁকগুলোকে; যে মুহুর্তে সাদা থোপা থোপা বেতফলের সাথে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নুন হলুদ মেখে নিয়েছে তাঁর সুবিনয় শৈশব সে মুহুর্তে তো তিনি এক ফর্মার এক কবিতা আবিষ্কার করে ফেলেছেন ! ভেতরবাড়ির মৌতাতে তলিয়ে গেছে বাইরের নীরব মরজগত। ফাঁস আলগা করলেই সেখানে হামাগুড়ি বেষ্টিত পৃথিবীর ক্লাসরুমে। না একে আমি আধিবিদ্যক বা আধ্যাত্মিক কবিতা বলতে নারাজ, বরং ‘অক্ষয় মালবেরির’ ভাষাতে-ভাসাতে-ভরাটে-ভাঙনে ছড়িয়ে রয়েছে এক সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কবিতা। মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার দিকে তিনি দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কিছু শাশ্বত ফুলের সুঘ্রাণ ও নবীনতা। যার ভেতর দিয়ে আমাদের সাঁকো যার ভেতর দিয়ে আমাদের মেঘ যার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা ঘনিয়ে তুলছে নোনাজলের এক প্রতিনিধি। হ্যাঁ, অত্যন্ত সন্তর্পণে মণীন্দ্র গুপ্ত ওপাশের দরজা খুলে রেখেছেন কাউকে না জানিয়েই, সেসব দরজা ফুলের পোশাক পরা আর তাদের ফুটো দিয়ে চলে যাওয়া পথটুকুই মণীন্দ্র গুপ্তের জাদুপথ। পাঠককে টেনে নিয়ে চলেছে সেসব পথ কোনো তৃতীয় স্তবকে। জীবনের মাঝের ফাঁক ধরে ধরে যেন পূর্বজন্মের দিকে চলেছে মহাস্তব্ধ এক মুসাফির। বিধিসন্মত বেড়ে ওঠার বাইরে তাঁর বিগত জীবন নিপুন তুলির টানে তুলে রেখেছে অলৌকিক চিত্রশালা। সেখানে একের পর এক ফুলের পাপড়ি মোহগ্রস্থ করে ফেলছে নিস্তরঙ্গ অতীতের তন্দ্রায়; এক ফুল থেকে বেরোলেই অন্য এক ফুলের দেশ অন্য এক পথের শেষ অন্য এক রাজ্য। শিউলিফুলের মধ্য দিয়ে বেরোলে সাদা মেঘের দেশ, লাল সন্ধ্যামণির ওপারে আবার আবছায়ায় চলাফেরা করা মেয়েদের দেশ। জ্যোৎস্নায় স্নান করা হাসনুহানা সরল হাওয়ায় দুলিয়ে দেয় চাঁদিনী জলসার দেশ আর স্বর্ণচাঁপার ফুটো দিয়ে বেরোলেই মুনশীবাড়ির দেশ। হ্যাঁ এই মুনশীবাড়ির কাছে এসেই চেতনার অক্ষয় ভাঁড়ারটি কখন যেন আমাদেরও দাঁড় করিয়ে দেয় জীবিতকল্পকে নির্মাণের তাগিদে। কেবলমাত্র এক অনুরণন, স্ট্রান্ট বা গিমিকের থেকে বেরিয়ে এসে এক অতীন্দ্রিয় অঞ্জন-মণীন্দ্র গুপ্তের স্বতন্ত্র্য ভাষাতেই পাঠক খুঁজে পাচ্ছেন তার নিজের নিরীক্ষা, বাঁশের চোঁচ দিয়ে নাড়ি কাটা কয়েকটা যাপন, বিচ্ছিন্নতায় বিলাপ হয়ে যাওয়া নৌকা ভর্তি বাল্যের চিঠি, খুঁজ়ে বেড়াচ্ছে গয়না হারানো সামান্যতা। মানুষের চারপাশে মানুষ খুলে বসেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। এক অবিশ্বাস্য বিপননি অথচ সেখানে কোনো বিক্রিবাট্টার প্রশ্ন নেই কেবল সন্ধিকালে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ জীবনপাঠ। যেখানে কেবল বীজ রোপন হয়। ''কবিতার জীবন ও দুষ্প্রবেশ্যতা'' প্রবন্ধে মণীন্দ্র গুপ্ত যখন বলেন- “সমস্ত জন্ম প্রক্রিয়াই আমাদের দৃশ্যের বাইরে, গর্ভের আড়ালে ঘটে। কিন্তু প্রাণীজগতের জন্মসমূহ ক্রমান্বয়ে ইন্দ্রিয়গম্য, আর কবিতার জন্ম-প্রক্রিয়া সর্বইন্দ্রিয়াতীত। কিংবা তাও হয়ত নয়। কবিতার জন্মের জন্য আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ই অত্যন্ত স্পর্শাতুরভাবে ক্রিয়াশীল। শুধু প্রত্যক্ষত নয়। মনই এক্ষেত্রে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রতিভূ হয়ে দারুণভাবে জাগ্রত হয়ে ওঠে, জাগরূক থাকে-দেখে, গন্ধ নেয়, স্পর্শ করে, শোনে, আস্বাদ নেয়। আর এভাবেই সে এক অপ্রত্যক্ষ, কিন্তু কবির নিজস্ব, দ্বিতীয় ভুবন গঠন করে কবিতার জন্ম সম্ভব করে। আমরা বুঝতে পারি, কবির মনই হচ্ছে কবিতার জন্মক্ষেত্র। কিন্তু বীজ !-কী এই বীজ ? এবং তারা আসে কোথা থেকে ?…… এই বীজ, প্রত্যক্ষ ও প্রাথমিক অবস্থায়, আমাদেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু পরমুহুর্তেই সে স্মৃতি-অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতাজাত অনুভূতির স্মৃতি। এবং কবিতা যেহেতু অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংলগ্ন থেকে লেখা যায়না, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ লৌকিক অভিজ্ঞতা যতক্ষণ না দ্বিতীয় ভুবনের অলৌকিকতায় প্রবেশ করছে ততক্ষণ কবিতার জন্মচক্র সঠিকভাবে আরম্ভ হয় না, অতএব বলতে পারি স্মৃতিই সেই বীজ়। “আর এই স্মৃতিকেই, বর্ণচোরা অভিজ্ঞতাকেই মণীন্দ্র গুপ্ত 'অক্ষয় মালবেরি'তে গাঢ় করে তুলেছেন কবিতা আর ছবির আশ্চর্য মিশেলে। জরাগ্রস্থ এক দ্রষ্টা যিনি কেবল তাঁর স্মৃতিকে আঁকড়ে থাকেননি বরং তাঁর প্রথম বীজকে দিয়েছেন ব্যক্তিত্বের গহন। আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণার লিনিয়ার, লহমা নির্ভর অভিজ্ঞতাকে দিয়েছেন সৃষ্টির লুকোনো রসদ ! মণীন্দ্র গুপ্ত প্রশ্ন করেছেন কোলাহলের বাইরে থেকে যাওয়া সমাহিত বিশ্বটিকেই। আর এখানেই তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যান হয়ে উঠেছে কবিতার ভাষ্, জীবনের ভাষ্য। কৃষ্ণরশ্মিময় এক ছোট গ্রহে বসে দেখতে চেয়েছেন ছয় ঋতুর বর্ণালী। স্তব্ধ বায়ুভুতে বসে বসে দূরের মাঠের ছবি এঁকেছেন তিনি, কাছের অন্ধকারের কবিতা লিখেছেন। ‘অক্ষয় মালবেরি’ কোথাও সাবেকী আত্মজীবনী থেকে বেরিয়ে এসে কবিতার কোলাজ হয়ে ওঠে আমাদের আটপৌরে জীবনে। আমরা আমাদের যাপন রেখে যাই জ্যোৎস্না রেখে যাই বিষণ্ণতা রেখে যাই বিলাপ রেখে যাই, তুমুল ভিক্ষার মাঝে বেড়ে উঠতে দিই আমাদের ভেতরের পালক আমাদের চারদিকের শেকড়। কোথাও যেন বাড়তে বাড়তে একটু একটু করে তাঁর আত্মজীবনী এক তুখোড় ছবি হয়ে ওঠে যেখানে আমাদের, পাঠকেদেরও ‘অন্যমন জানলা রয়েছে খোলা’।

না, কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, কলাকৈবল্যবাদও নয়, বরং কংক্রিট ও সাবলাইম-যাপনের এমন লুসিড স্টাডিই হল ‘অক্ষয় মালবেরি’। প্রতিটি উপলব্ধিই সেখানে ব্যক্তিগত আবার প্রতিটি উপলব্ধিই নৈর্ব্যক্তিক। কোনো বিরোধ নেই। কেবল ছবিটার বড় হওয়া আছে। কি সেই ছবি ! যা গল্প বলার ছলে যাপনের বরফদেশে গুলিয়ে দিচ্ছে রিক্ত পথের নেশা ! বোতল ভাঙার শব্দে আমরা জেগে উঠছি লম্বা রাতের শেষে, তেষ্টা পাচ্ছে আমাদের। এই কি সেই মণীন্দ্র গুপ্তের ‘দূরে রেখে আসা জীবন’ নাকি গভীর উদ্ভিদ মেখে নীল অক্সিজেন মেখে আমাদের ‘সূর্যাস্তসমগ্রের’ শেষে মথ আঁকা মালতীলতা ! আসলে ভূতগ্রস্থ অশরীরী আমরা, চারপাশের সন্ধ্যে ঢেকে রেখেছি পলাশ দিয়ে, আর আলো ফুটলে দেখছি বাড়ীগুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছে আশ্রয় বোঝাতে স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে অথচ এত অভিলাষের মাঝে এত অবঅতীতের মাঝে এত অনন্যের মাঝে সাকিন বলতে কেবল নির্বিকার এক থাকা। বয়ন শরীর থেকে আয়ন শরীর-কোন অরূপকে ধরতে যে সে উঠছে ফুটো নৌকোয়, শব্দ করছে পূর্বসূরী নৈঃশব্দকে জুড়ে জুড়ে! আর এই অরূপকেই যেন রং বুলিয়ে রূপান্তরিত করে চলেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। তাঁর জেগে থাকার ভেতরই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে নিরাভরন দৃষ্টির নয়নতারা। যারা প্রকৃতিকে এই অনন্ত পাকচক্রকে কেবল দেখতে চাইছে না শুনতে চাইছে আঁকতে চাইছে। ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ প্রবন্ধে অবন ঠাকুর বলেন- ‘জেগে থাকার দৃষ্টি ধ্যানে দেখার দৃষ্টির সংগে মিলতে তো পারে না, যতক্ষণ না ধ্যানশক্তি লাভ করাই নিজেকে। এই জন্যেই কবিতা সংগীত ছবি এ সবকে বুঝতে হলে আমাদের চোখ কানের সাধারণ দেখাশোনার চালচলনের বিপর্যয় কতকটা অভ্যাস ও শিক্ষার দ্বারাই ঘটাতে হয়, না হলে উপায় নেই। মানুষের সৃষ্টি বুঝতে যদি এই নিয়ম হল তবে সৃষ্টিকর্তার রচনাকে পুরো রকম বুঝে সুঝে উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার যে অপেক্ষা রাখে তা বলাই বাহুল্য। ……অস্থির হয়ে ভ্রমণ করছে এই দুটি মাত্র আমাদের চোখের দৃষ্টি, একটু অন্ধকারে ঝাপসা দেখে, বেশী আলো পেলেও ঝলসে যাবার মতো হয়, দূরবীন না হলে খুব দূরের জিনিস দেখাই হয়না আমাদের ! আবার যখন তিলকে দেখি তখন তালকে দেখিনা, তাল দেখতে গেলে তিল বাদ পড়ে যায়। ……শিল্পকার্য, সঙ্গীত, এবং কোনো বিষয়ে পটুতা হয় না হতে পারে না ততক্ষণ, যতক্ষণ নানা ইন্দ্রিয়ের নিত্য এবং স্বাভাবিক ক্রিয়ার কতকটা অদল-বদল ঘটিয়ে না তোলা যায়। এই অদল বদলই যেন করতে পেরেছেন কবি গদ্যকার প্রাবন্ধিক মণীন্দ্র গুপ্ত। কিংবা বলা ভালো চিত্রী মণীন্দ্র গুপ্ত। যার নিজের কথাতেই ‘অন্ধকার অলৌকিক চিত্রশালা বুকে নিয়ে জন্মলগ্নে আমিও এসেছি’। আশ্চর্যভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের এই চিত্রশৈলীর দিকটা বেশ কিছুটা অগোচরেই থেকে গেছে পাঠকের কাছে। কেবল প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেই নয় বরং তাঁর প্রবন্ধের কবিতার আত্মজীবনীর ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে লিরিকাল ফটোগ্রাফি। কবি যখন ছবি আঁকেন অথবা ছবিকার যখন প্রবন্ধ লেখেন খুব স্বাভাবিক শব্দ ও রং-এর রহস্যময় ঘনত্ব পাঠককে নিয়ে যাবে এক অনির্বচনীয় অনির্বাচ্য স্তব্ধলোকে। ‘অন্ধকারে তো কবিরা দেখতে পায় আর সন্ন্যাসীরা শোনে রাতে’- আর যখন সে সন্ন্যাসীর সাহিত্যতীর্থ পৃথিবী আকাশ বায়ুমন্ডল আর ঋতুচক্রের সাথে ওতপ্রোত জড়িত হয়ে পড়ে একজন কবি, যখন এক কুড়ানীজীবনই হয়ে ওঠে তাঁর আর্দশ বৃত্তি তাঁর মহাজীবন তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মাটি ঘিরে থাকে তাঁর সার্বিক সৃষ্টিকে, শূন্যতাকে স্থিরতাকে ছুঁয়ে থাকে এক রূপময় অপর। তাঁর আর্কিটাইপে লেগে থাকে প্রকাশের রং- যার ওপর ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ে সবুজ, খয়েরি, লাল, বেগুনী, নীল, ময়ুরকন্ঠী কিংবা কেবলমাত্র বোধরঙের বেপরোয়া উপনিষদীয় সমর্থন। ‘অক্ষয় মালবেরি’তে শব্দের মুক্তি চেয়েছেন মণীন্দ্র, শব্দকে তার নিকষ কালো থেকে আসমানী নীল কিংবা আরক্ত পূরবী করতে চেয়েছেন। তিনি তো সংগ্রাহক, এই জন্ম দুঃখ মৃত্যু আনন্দ পরিপার্শ্বের মাঝে গেঁথে থাকা বিরাট জীবন থেকে ভরিয়ে নিচ্ছেন ক্ষুদ্র মানুষের ছবিকে। ছবি ও রঙের প্রতি তাঁর সহজাত আর্কষণ সেই দ্বন্ধমধুর দেহটিকে ভরিয়ে তুলেছে এক অতিজাগতিক অলংকারে। যে সংসারপৃথিবী থেকে কথা তৈরী হচ্ছে তাকেই চৈতন্যময় চিত্রজগতের সবুজে এঁকেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। ‘পরবাসী কুড়ানী ও দারুমা সান’তে জীবন ও জগৎ প্রসঙ্গে যখন তাঁর ভাবনায় উঠে আসে- “নিজের অজান্তে তারা ঢেঁকির শাক তুলতে গিয়ে স্পর্শ করে রজস্বলা মাটির সবুজ ভাঁজ, তেলাকুচো লতার সঙ্গে তারা কুড়োয় কিছুটা আগের রাতের শিশির, মেটে আলুর সঙ্গে পৃথিবীর খানিকটা জঙ্ঘা-অস্থি তুলে আনে, বনধুঁদুলের সংগে কুড়োয় একটু অস্তসূর্যের রশ্মি, স্কোয়াশের সঙ্গে কুড়োয় হঠাৎ ঘনিয়ে আসা দ্বিপ্রাহরিক মেঘমেদুরতা, পাকা আম, পাকা তালের সঙ্গে কুড়োয় পুরো গ্রীষ্ম বর্ষার সৌগন্ধ্য’ তখন খুব সহজেই অনুমেয় তাঁর প্রবন্ধে তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে শব্দপ্রভা কীভাবে অতিরিক্ত হয়ে উঠবে দৃশ্যের প্রতীকিতে। বোধের এত কাছে যে শিল্পী স্তব্ধবাক, রূপদর্শী, তাঁর শাব্দিক গৃহসজ্জাতে দৃশ্যের অনন্যপরতন্ত্রাই স্বাভাবিক, যেন স্বরূপ উদঘাটনে একটি বীজ-শব্দ থেকে মণীন্দ্র গুপ্ত খুঁজে চলেছেন আর একটি বীজ-দৃশ্য, তার গড়ন, তার সচেতন সূক্ষ্মতা তার দৃশ্যমান দীর্ঘতা তার অজস্র অগন্য রঙের কণা কিংবা তার জ্যামিতিক অস্থিতি বিস্তৃতি। তাঁর বাকশস্যের অফুরন্ততা চরিত্রগুলির নির্মাণের সাথে সাথে আমাদের সেসবের দৃশ্যগত নাড়াচাড়ারও শরিক করে যায়। কখনও দেখি মানুষ আর মানুষের শরীর ঘেঁটে তিনি যা আবিষ্কার করছেন তা শব্দের বাইরে ব্যাখার বাইরেও কোথাও চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রস্তুতিহীন কিছু ছবি; ঠাকুমার বন্ধু প্রতিবেশীদের যে অবয়ব গভীর নিরীক্ষণে মণীন্দ্র গুপ্ত তুলে এনেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে তা আমাদের কোথাও এক সাদা কালো ছবির দিকে, তেল জলের একধরনের মাল্টিক্রোম বিন্যাসের দিকেই নিবিড় করে- “কারো চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে চোখের কোলে ছায়া ফেলেছে। কারো কাঁচাপাকা চুলের গোছায় ঘেরা ধূসর অস্পষ্ট মুখখানা যেন কঠিন বট-অশ্বত্থের ঝুরি নামা মন্দিরের কবাটভাঙা দুয়ারের অন্ধকার, কারো মুখে অজস্র কাটাকুটি রেখা যেন বিকেলের নদীর চরে পাখিপক্ষীর সারা দিনের পায়ের দাগ, একজনের সামনের দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে দুপাশে দাঁতদুটো লম্বা আর বাঁকা হয়ে এমনভাবে নিচের ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে যেন মনে হয় সে মানবী না, প্রত্নযুগের বৃহৎদংষ্টা বাঘিনী, এখন বিরক্ত, মন্থর। আর মাণিক্য বুড়ী তো প্রাচীন মাতৃগোষ্ঠীর একজন-ঘন সাদা চুল পুরুষদের মত ছোট করে ছাঁটা, কঠিন সোজা নাক, কঠিনভাঁজ চিবুক, রোখা সাবলীল দেহ……”...যেন শিল্পীর কল্পনায় দর্শক ও শ্রোতার মাঝের দুর্বোধ্যটুকু স্থবিরতা ভেঙে সহজ উৎসবে নেমেছে। মণীন্দ্র গুপ্ত সেই সূত্রধর যিনি কেবল একজন আত্মজীবনীকার নন বরং পাঠের গভীরের নিঝুম চিত্রের রচয়িতাও, যিনি জগৎচিত্রকে ধরে ফেলছেন তাঁর জিয়লশব্দের মধ্য দিয়ে। আর এভাবেই থাকার ভেতর আরও অনেকখানি থাকাকে জীবন্ত করে তুলেছেন, যাদুবাস্তবতা দিয়েছেন তার শৈল্পিক চেতনাকে। একজন চিত্রকর যিনি তাঁর অক্ষরকে ছবির, রঙের তুলিতে বেঁধেছেন, ব্যবহার করেছেন পৃথিবীর সাদা অংশ আর ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজস্ব কিছু দেখার পদ্ধতি, মনোজগতের রঙীন কিছু পাঁজিপুঁথি। 'অক্ষয় মালবেরি'র পরতে পরতে দৃশ্য আর বাকের এমন অফুরন্ত মেলবন্ধন আমরা কিছু সংলাপের মধ্য দিয়ে কিছু দৃশ্যপ্রতীকের মধ্যে দিয়ে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারি:-

১- আমি রহস্যময়ভাবে আকৃষ্ট হতাম চালতার ফুলে। বিরাট গাছে, উঁচুতে, জমাট টুকরো টূকরো জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া যেন স্বপ্নের দেশের ফুল। তার শুভ্রতা আর পাপড়ির গড়ন দেখতে দেখতে কোনো গভীর সৌন্দর্যের কথা অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে, নির্জ্ঞান মনের মধ্যে অন্য কোনো দূর জন্মের স্মৃতি ফুটব ফুটব করেও অন্ধ হয়ে যায়।

২-পাহাড় যেন উঠে বসেছে, তার গায়ের রোম অপরাজিতার মতো নীল, আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছে সে, বর্ষায় তার বুকের যে জায়গাটা অনেকখানি পাথর-জঙ্গল সমেত ধসে গেছে সেখানে দেখা যায় মাটির নরম বাদামী রং। পাহাড়ের ঘাড়ে গলায় যে মেঘ ঘন হয়ে জমে আছে সেই নতুন মেঘের রং আর ঐ বুকভাঙা আনকোরা মাটির রং এত দূর থেকে প্রায় একই রকম দেখায়

৩- হঠাৎ আমার মাথার উপরে শূন্যে যে কোত্থেকে কয়েকশো লাল ফড়িং এসে চক্রাকারে উড়তে লাগল। একসংগে এত লাল রঙের ফড়িং আমি কোনোদিন দেখিনি। নীলাভ আকাশে অনেক উঁচুতে লাল মেঘ, আর ঠিক তারই নিচে পৃথিবীর কাছাকাছি অগণন লাল ফড়িঙের ওড়া-এর তাৎপর্য কি, ভাবতে ভাবতে মেঘ পাঁশুটে হয়ে গেল, ফড়িঙেরা লুকিয়ে পড়ল

৪- কখনও দুটো বিরাট গোসাপ লড়তে লড়তে হুড়মুড় করে ঝোপ ভেঙে আচম্বিতে এসে লাফিয়ে পড়ত জলে।……কোনোদিন একটা একলা গোসাপ গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে জলের দিকে এগোত। নিষ্প্রভ তার ভাবলেশহীন চোখ আর সারা শরীরে প্রাগৌতিহাসিক শীতলতা। গভীর লাল বর্ম পরা পোকা ভোঁ করে কোত্থেকে উড়ে এসে সবুজ পাতায় বসত। লতার আকর্ষী উন্মুখ হয়ে থাকত কিছু একটা আঁকড়াবার জন্য। হঠাৎ কালো আর পাটকিলে মেশানো কুবো পাখি ডেকে উঠত কুব কুব কুব কুব কুব।

আত্মজীবনীর প্রায় সবটুকু জুড়েই নবীকৃত হয়ে চলেছে এমনই সব বর্ণিল প্রবহমান। প্রতিমুহুর্তের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, সংবেদন যেন তার অন্ধিতে সন্ধিতে পরাগে কেশরে নান্দনিক আলোকসম্পাত নিয়ে শরীরহীন ক্যানভাস নিয়ে উঠে পড়ছে ছবির তন্ময়তায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ‘অক্ষয় মালবেরি’ মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজীবনী নয় বরং টানটান রঙের অলংকারিতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “শিল্পকে শিল্প হতে গেলে সর্বাগ্রে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তারপরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ”। এই সত্য কেবল বক্তব্যের সত্য নয় তার দৃশ্যের আকরণ আর নিবিড়িতার সাথে অনুভবিত হওয়ার সংযোজিত হওয়ার সত্যতা। ছবি আর রঙের প্রতি যে লেখকের সহজাত আর্কষণ, খুব স্বাভাবিক যে তিনি তার শব্দের ভাষার বাহ্যিক ব্যাখানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে কোথাও দৃশ্যকল্পের দেহপুষ্টিতে আত্মীয়তা অনুভব করবেন। 'অক্ষয় মালবেরি'তেও তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাদা কালো ত্রিমাত্রিক সাম্য আর প্রতিসাম্যের অনুপুঙ্খগুলো, রয়েছে অনুভুতির ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে ছেঁকে রাখা তুমুল কালার ফোটোগ্রাফি। চেতনার গভীরতম স্তরে পৌঁছতে রঙের প্রতিভাস তৈরী করেছেন মণীন্দ্র। তিনি কেবল আঙ্গিকসর্বস্ব আত্মজীবনী লিখতে চাননি বরং ক্যানভাসের মাঝে পেতে চেয়েছেন দার্শনিক ভাষা, শুকনো পাতার ফুটো দিয়ে তিনি কেবল জীবনীগ্রন্থ দেখছেন না দেখছেন অনন্তসম্ভব এক জগতের ঠিকানা। ছবির কাঠামোয় আপাত জড়কে দিচ্ছেন অন্য এক নতুন চোখের পর্যবেক্ষণ। ‘রং’ বইতে ধীমান দাশগুপ্ত বর্ণ অভিজ্ঞতার একটা বিশেষ দিক হিসেবে বর্ণবিনিশ্চয় অর্থাৎ এক রং থেকে অন্য রংকে পৃথক করা আর সঠিক ভাবে চিহ্নিত করার ক্ষমতার উল্লেখ করেছেন আর এই সামগ্রিক বর্ণবিনিশ্চয় বা সূক্ষ্ম বিভাজনের ক্ষমতা শৈশবেই গড়ে ওঠে মণীন্দ্রেরও। গৈলা গ্রামের মণীন্দ্র তাঁর বাল্যের কাঁচা কঞ্চির কলমে বনের সবুজ কালিতে হোগলার পাতায় যেন এই বর্ণবিনিশ্চয়কেই রেখে এসেছিলেন মেঘ হাওয়া জলফড়িং পাখি গাছ আর ছায়ার আদলে। আর তাই তাঁর প্রৌঢ়ত্বের ক্যালিডোস্কোপ, যার ভেতরে তিনি মিশিয়ে নিচ্ছেন সেইসব বর্ণবিহ্বল মুহুর্ত, আর বানিয়ে ফেলছেন এক নিমগ্ন মুক্তি। প্রাকৃতিক উপাদানগুলো থেকে নীরব বিপ্রতীপ অন্য এক ভাষা তুলে এনেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে। দৃশ্যপৃথিবীর কালেকটিভ কনশাস থেকে লক্ষাধিক অণুকবিতা নিয়ে যেন, ফিরে আসছেন কালেকটিভ আনকনশাসে, ফিরে ফিরে আসছেন বিষয়হীন এক কেন্দ্রের ভরাজীবনের কাছে। সম্পূর্ণ ‘অক্ষয় মালবেরি’ই হয়ে উঠছে তাঁর পরিকল্পিত প্রচ্ছদ, ছবিকে ধারাবাহিকভাবে নির্সগের পাঁজর থেকে তুলে এনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শব্দের প্রদর্শনীতে। এ যেন আত্মঅন্বেষণ, ভেতরের শূন্যস্থানগুলো রং দিয়ে ভরাট করে দেবার এক অতলান্ত আকুতি। এমনই এক প্রতিলিপিতে দাঁড়িয়ে ‘অক্ষয় মালবেরি’। অন্য এক পৃথিবী। অলীক এরিনা। যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর ছবি আরম্ভ হচ্ছে শত শরদ মানুষের আয়ু নিয়ে, মরণের আগে বোকাবোকা চোখের তাকিয়ে থাকা নিয়ে আর শেষ হচ্ছে দূরে রেখে আসা এক জীবনের কথা মনে করতে করতে, পুনরায় সম্প্রসারিত অন্য এক জীবনের দিকে ফিরে আসা নিয়ে;  অভাবিত হ্যালুসিনোজেন যেখানে দাঁড়িয়ে একটা ন্যাংটো দেশ একটা খোলা ছবি একটা ফুলসুদ্ধ ভাঙা ডাল কিংবা ঘন রঙের এক বিস্তার থেকে থেকে বলে চলেছে- ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে’; মণীন্দ্র গুপ্তের রঙের পৃথিবী এভাবেই একবর্ণীয় শব্দকে কল্পনার প্রেষণার বহুধায় রেফার করছে বারবার আর তাঁর আত্মজৈবনিক ভাষা পেয়ে যাচ্ছে চৈতন্যময় কিছু দৃশ্যের বারমাস্যা।

কেবল সত্তা নয়, কিছু শূন্যতার পংক্তিও শঙ্খ লেগে আছে ‘অক্ষয় মালবেরি’র গায়ে। জেন সাধকের মত মণীন্দ্র গুপ্তও ঘনীভূত কোলাহল থেকেই তুলে নিয়েছেন পরিপূর্ণ একটি শূন্যতার ছবি। আত্মজৈবনিক আখ্যানে যেখানে প্রতিমুর্হুতের বহুমাত্রিক কোলাহল সেখান কিছুটা হলেও এ জাতীয় নির্বাক নির্বাণ হেঁয়ালির মত শোনাবে, কিন্তু এই মৌনতাই মণীন্দ্র গুপ্তের জীবন সঞ্চিত সারাৎসার। যেমন মৃত্যু সেখানে কম আলোর কোন উপহার নয় বরং চারপাশের শূন্যতায় সে যেন এক মহার্ঘ্য দোহার, বারবার যে জীবনের মুখস্থ শিল্পে জীবনের রিহার্সালে আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় জোয়ারভাঁটার সম্পর্কটি, সুখদুঃখের আলোআঁধারিটি। শাস্ত্রীয় শূন্যতার থেকে দার্শনিক শূন্যতার দিকে ক্রমপ্রসারিত হয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মিক বয়ানটি। সেখানে কেবল আলোর নয়, অন্ধকারেরও নড়ে ওঠার আওয়াজ আছে, ছেঁড়ামানুষের আগুন নিভে গেলে ছাইয়েরও অকূলবিস্তীর্ণ জেগে থাকা আছে। আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ- ‘স্কাল্পটিং ইন টাইম’ এ চলচিত্র পরিচালক তারকোভস্কি বলেন- “By means of art man takes over reality through a subjective experience. An artistic discovery occurs each time as a new and unique image of the world, a hieroglyphic of absolute truth. It appears as a revelation, as a momentary, passionate wish to grasp intuitively and at a stroke all the law of this world—its beauty and ugliness, its compassion and cruelty, its infinity and limitations… Through the image is sustained an awareness of the infinite: the eternal within the finite, the spiritual within matter, the limitless given form. আর ঠিক এর পরেই যখন মণীন্দ্র গুপ্তকে বলতে শুনি ''মানুষ কোথায় যায়?- এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে এখনো কেবল সেই ছবিটা আসেঃ লাল মেঘের মধ্যে দুজন মাঝি গুণ টেনে চলেছে'' তখন নিসর্গ সংবেদের মাঝে একজন শিল্পীর উত্তোরণের চাকলা চাকলা সবুজগুলো খুঁজতে পাঠকও ডুব দেয় চেতনার অন্তহীন সন্তরণে। সবুজ জাজিমে ভরা তাঁর হায়রোগ্লোফিক ‘অ্যাবসিলিউট ট্রুথ’ প্রসঙ্গে শুরু হয় আমাদের রহস্যাচার আমাদের কসরৎ। মৃত্যুর কাছে এসে মগজ যেন বারবার হর্ণ দিয়েছে মণীন্দ্রকে বারবার দু মানুষ সমান সবুজ ধান গাছ ঢেকে দিয়েছে প্রত্যাবর্তণের নৌকাকে, মৃতদেহের সংস্কার করতে করতে ঢিল ছুঁড়েছে কেউ শরীর নামের অতিরিক্ত তারল্যে যেখানে বৃথা ঘুরে মরছে মানুষ আর মাকড়সার সুতো দিয়ে মেঘ দীর্ঘ করছে। আদিভূমিতে ফেরার আগেও মণীন্দ্র গুপ্ত কখনও বলছেন না আমাদের আড্ডা শেষ অথচ কেন্দ্র থেকে কিনারা ধরছেন। আসলে মানুষ ফুরিয়ে যায় এই নেসেন্ট ধারণার কাছে এসে তিনি কখনই ‘নেই’-র যৌথরচনা খোঁজেননি বরং না-থাকার ধারণার মধ্যেই সেঁধিয়ে গেছে এক অন্যতর থাকার সমীকরণ। আত্মকৌতুক থেকে তিনি প্রসারিত হয়েছেন আত্মার বায়ুরূপের দিকে, খেলাঘরের শেষে লুকিয়ে রাখা একটা শরীরহীন ‘আমি’র দিকে। যে নকল দুঃখকে আত্মকরুণা নামে বাল্যের মণীন্দ্র খুঁজে বেড়াতেন মাটিতে গাঁথা ভাঙা বোতলের সবুজ টুকরোরূপে সেই মণীন্দ্র গুপ্তকেই যাপনের বিস্তৃত পর্বের শেষে দেখি জীবনের ডেরিভেটিভ খুঁজে পেতে। তাকে বলতে শুনি- ''গভীর অন্ধকারে ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত”। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে কি সবচেয়ে কম ভয়ংকর মনে হল মণীন্দ্র গুপ্তের ? আসলে শোকের মাঝে তিনি কোথাও খুঁজে পেয়েছেন স্থৈর্যের প্রতিমূর্তি, একের পর এক মৃত্যুর অনিকেতে খুঁজে পেয়েছেন যাপনের অতীন্দ্রীয় দার্শনিকতা। মৃত্যু, সে যেন ‘অনির্বচনীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিথর, তার হাত ঘাই মারছে অনন্তে’। শিশু বয়সের লঘু জীবনেও বেঁচে থাকার নিরাবয়ব সারাৎসারে খুঁজেছেন দরজার ফাঁক দিয়ে ডেকে নেওয়া অবিকল জীবনটিকে। শোকে দাঁড়িয়ে শোকের ভেতর বেঁচে থাকা সুরটা একজন কবি একজন গদ্যকার একজন আত্মজীবনীকার ছাড়া কেই বা সঠিক চিনতে পারবেন, একজন মুক্তজীবী মণীন্দ্র ছাড়া কেউ বা জানতে পারবেন তন্ত্রের সাবালক তাত্ত্বিকতাগুলো! অখন্ড 'অক্ষয় মালবেরি'র মৃত্যু সম্পর্কিত কয়েকটা চরিত্র পাঠ ও সংলাপকে কেন্দ্র করে সহজেই আমরা প্রবেশ করতে পারি অনুচ্চারিত গর্ভদেশে, যেখানে মৃত্যু কোনো ফাঁক নয় পার্থক্য নয় বরং এক অর্ধপরিচিত সত্য, ক্ষয়ে ক্ষয়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া জন্ম থেকে জন্মান্তরের অপেক্ষা:-



চরিত্র
সংলাপ/স্থুলশরীর
অনুচ্চারিত অন্তর্লোক
  মা
আমাদের চেনাশোনাভালোবাসা হবার আগেই মা যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছরআর আমরা দশ মাস। মায়ের এই অসমাপ্ত জীবন বা আমার জীবন থেকে তাঁর এই চিরঅপসারণ একটা   প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র।
শোক যেন এখানে জীবনের সব চেয়ে অর্থময় ছবি শরীরের অপূর্ণতাব্যর্থতা পেরিয়ে কনভেনশন পেরিয়ে সে যেন নিজেকে শনাক্ত করতে পারার এক আলোকিত সত্য। শরীরের বহিরাবরণ থেকে সান্নিধ্য ও সংযোগ থেকে অনিলম অমৃতম অর্থাৎ দেহ গেহ হতে স্থির অকম্প এক নিভৃত ন্যারেটিভ। বরিশালের গৈলা গ্রামে মণীন্দ্র গুপ্তের জন্মস্কুলজীবন বরাক নদীর তীরে শিলচরে আর কলেজপর্ব কলকাতায় আর তারপর লাহোর বা উত্তরপশ্চিমের সীমান্তের কয়েক জায়গায় চাকরিতে যোগ-মোটামুটি এতটুকুই অক্ষয় মালবেরির’ জাগরূক শরীর। কিন্তু তাঁর বীজ ও অবয়ব? সে আসলে এক আরণ্যক মানুষের কোটরের দরজা খুলে প্রাণ পণে দৌড়ে যাওয়া বিশাল মহীরূহের দিকে। মনোময় ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ আমি থেকে এক   অকর্ষিত আমির দিকেই তাঁর আত্মকৌতুক। মৃত্যু তাঁর কাছে জীবিত যেভাবে জীবন তাঁর কাছে জীবিত; অন্ধকার ছাড়া আলো যেভাবে এবং অবয়বস্বরূপ ছাড়া যেভাবে আত্মার দর্শন সম্ভব নয় ঠিক সেভাবেই অক্ষয় মালবেরি'র ছত্রে ছত্রে আমরা খুঁজে পাই এক আদিত্যমন্ডলস্থ পুরুষযিনি প্রাণবায়ু খুঁজে চলেছেনঢের গভীরের দৃশ্য দেখে চলেছেন যিনি। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত আর তাঁর চরিত্ররা কোথাও যেন নির্বিকারবিরাট আকারের এক থাকার মাঝে একটা দোলা দেওয়া নৌকা থেকে   একটা নৈর্ব্যক্তিক নিবেশতা থেকে বারবার যারা তলিয়ে যেতে দেখছে এক জড়বিদ্যালয় এক কারুবাসনা। দেখা যায় না যার এপার ওপার এমন এক অবস্থান থেকে মণীন্দ্র গুপ্তও দেখে চলেছেন- “জনমানবহীন দ্বীপের বালির উপর দিয়ে চাঁদের আলোয়/নৌকা ভেসে যায়” ……
ছোড়দাদুর মা
বাড়ির শ্মশানের দোলমঞ্চের পাশে তাঁকে চিতায় শুইয়ে আগুন দেওয়া হল। হরি--বলোহরি--বলোহরি হরি বলো বলে সবাই উচ্চৈঃস্বরে যেমনি ধ্বনি দিচ্ছে,আগুনও তেমনি লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠছে। কোথায় শোক বেশ একটা কাজ চলছে যেন-একজনের দীর্ঘ জীবনের চিরকালের মত কাজ।
  কাকা
কাকা সত্যিই পদ্মপাতায় জল- যতক্ষণ টলটল করে ততক্ষণ ভারি সুন্দর। একদিন সে সত্যি সত্যিই পদ্মপাতায় জলের মত চলে গেল।
  দাদু
আমি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাঁকে স্নান করালাম। নতুন কাপড় পরিয়ে তাঁকে চিতায় শোয়ানো হল। আমি জ্বলন্ত একগোছা পাটকাঠি তাঁর মুখে ধরলামচড়াৎ করে দাড়িগোঁফে আগুন লেগে গেল। সবাই উচ্চৈস্বরে হরিধ্বনি দিয়ে চিতা ধরিয়ে দিল। আমার আর কিছু করনীয় নেইমুখ ফিরিয়ে দেখলাম পুকুরের ওপারে এসে ছোটমারা দাঁড়িয়ে আছে-মনে হলপুড়তে থাকা দাদু সমেত আমরাই জীবিতে দলেওরাঐ ওপারে সারি বেঁধে দাঁড়ানো মেয়েরা পরলোকের মানুষদুখঃময় তাদের ময়লা চেহারা। এপারে কত আগুনঐপারে অন্ধকারছায়া ।
  ঠাকুমা
ঠাকুমাকে তুলে মন্ডপে শুইয়ে দিয়ে কাকারা আম গাছ কাটতে গেলযাবার সময় আমাকে বলে গেল ঠাকুমাকে ছুঁয়ে বসে থাকতেপিসিমাদের অনেক কাজতারা বাড়িতে ছুটোছুটি করছে। আমি একা ঠাকুমাকে দেখছি-আদুড় বুকের হালকা স্তন দু দিকে নেতিয়ে পড়েছে, টিপে টিপে দেখছি শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। হাত আর ভাঁজ করা যায় না। ঠোঁটে কোনায় চার পাঁচটা পিঁপড়ে লেগেছে। লাইন দিয়ে আসছে আরো পিঁপড়ে। আমি এক হাতে তাঁকে ছুঁয়ে আরেক হাতে পিঁপড়ে মারতে লাগলাম।

‘সম্ভতিঞ্চ বিনাশঞ্চ যস্তদেওদোভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে।।'

যিনি মূল প্রকৃতির শুরু আর শেষ একযোগে জানেন, মৃত্যু অতিক্রম করে মূল প্রকৃতির উপাসনাতেই তার সর্বশেষ ধারণ। প্রকৃতির মাঝে এমনই এক মুক্তদিব্যজীবনের উৎসবে আত্মাকে জন্মহীন মৃত্যুহীনরূপে উপলব্ধি করে অনন্ত সর্বাতীত সত্তার মাঝে জন্মমৃত্যুর যে দ্বন্ধাতীত সাম্যাবস্থা তারই ব্যুৎপন্নতে ফিরে যেতে চাইছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। আর এখানেই তিনি দ্রষ্টা এখানেই তিনি সাধক যিনি প্রকৃতির মোহে মূর্চ্ছনা না চেয়ে প্রকৃতির অমৃতত্বের মাধুকরী চাইছেন। সৃষ্টির মাঝে সারস্বরূপের মাঝে ঘনঘন খুঁজ়ে ফিরছেন জন্ম মৃত্যু বোধের বাইরের এক ‘শাশ্বত বীজক্ষেত’। প্রকৃতির যে প্রেরণায় বর্তমান দেহ গঠিত তা নিঃশেষ হলেই মুক্তি আর তাকেই কোনোভাবে সম্ভূতি বা অসম্ভূতিতে আসক্ত হতে দিতে নারাজ মণীন্দ্র গুপ্ত। সসীম হতে অসীমে না বরং সত্তা হতে সত্তাহীনতায় প্রবেশের চেষ্টাই তাঁর মৌলিক। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর যেভাবে ‘মৃত্যুশোক’ প্রবন্ধে আমরা কবিগুরুকে বলতে শুনি- “তবু এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, তাহাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হইতাম। জীবন যে একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত নহে, এই দুঃখের সংবাদেই মনের ভার লঘু হইয়া গেল। আমরা যে নিশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা দেয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদি নহি, এই চিন্তায় আমি ভিতরে ভিতরে উল্লাস বোধ করিতে লাগিলাম। যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল। এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেইক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি বোধ করিলাম। সংসারে বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে-ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না। একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না- এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম।'' -মৃত্যুর কাছে দাঁড়িয়ে এমন এক নতুন সত্যের শরিক মণীন্দ্র গুপ্তও। মৃত্যু তাঁর কাছে সেই এক এবং একমাত্র অন্তর্লোকীয় ভাঙচুর, মায়ামোহ থেকে যা বেঁকে গিয়ে মিশে গেছে গৈরিক জগতের দিকে। মৃত্যু ও জীবনের থেকে যে বোধিসত্ত্বের জীবন সঞ্চয় করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত, হেঁটে চলার যে রহস্যসূচক একজন দুঃখী না সুখী না মানুষের পথিকসত্ত্বা হয়ে উঠেছে তাই তো  ‘অক্ষয় মালবেরি’র  অসীম বেপরোয়া শূন্য। ‘বিদায়ের দিনে কীভাবে বিদায় নিতে হয়’ জানে যে মানুষ সেই তো জেনেছে থাকার প্রসারতা, তুলাবীজের মত সেই তো উড়িয়েছে সূক্ষ্ম আলোরেখা; গভীর বনের মধ্যে দিয়ে সেই তো চলেছে একেবারে একা, উলঙ্গ। ‘অক্ষয় মালবেরির’ ছত্রে ছত্রে লেগে থাকা মৃত্যুচেতনার গর্ভবাস তাঁর কবিতায় তাঁর প্রবন্ধে তাঁর সার্বিক যাপনে আমরা লক্ষ্য করতে পারি; শিরোনামহীন কিছু শরীর মৃত্যুকে ঘিরে ঘিরে কীভাবে বেড়ে উঠেছে স্রেফ প্রাকৃতিক ক্যামোফ্লেজে, ছেঁড়া কাগজের মত টুকরো টুকরো আত্মার মাঝে কীভাবে উঠে আসছে কিছু ব্যঞ্জনার মানুষ কিছু বাণিজ্যের মানুষ তাদের জন্মজড়ুলের খোঁজে তাদের জলসার দেশের খোঁজে তাই যেন মণীন্দ্র গুপ্তকে চিনিয়ে দিয়েছে কোনো এক মুক্তকের ঠিকানা, উচ্চকিত অস্বীকারের ঠিকানা। তাঁর শোকসমগ্রে তাই বিষাদ নয় বরং ফুরফুরে মটরলতা ঢেকে দিয়েছে ফেরার রাস্তা, গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে থাকা - না থাকার মাঝের অগ্রন্থিত সহজ। তাঁর কাছে থাকা কেবল ‘জলের ওপর কালির ফোঁটার মত হাত পা মেলে ছড়িয়ে যাওয়া’ কিছু একটা। 'অক্ষয় মালবেরি'র মণীন্দ্র গুপ্ত এক মুক্ত পুরুষ যিনি প্রৌঢ়ত্বের বালিতে এঁকে চলেছেন এক বালকের বর্ণপরিচয়, দূরবীন দিয়ে দেখছেন কেবল একটি পথের জীবন যে মানুষের মাদুর আর বালিশ আর চার পাঁচখানা বই রেখে টলতে টলতে চলে যায় ‘মধুর মত গাঢ় সময়ের দিকে’। কিন্তু তিনি অবান্তরবাদী কবি বা লেখক নন, কেবল ঘনবনজ থেকে তুলে আনছেন সেই ব্যাকুল বন্দী প্রাণীটিকে আর ছেড়ে দিচ্ছেন আত্মানুসন্ধানের দিকে। ক্যামেরার লেন্স পড়ছে রক্তমাংসের শরীরে অথচ ফ্রেমবন্দী হয়ে উঠে আসছে চিরস্থায়ী প্রাজ্ঞ ছায়ারা। স্মৃতি নামের গুহার ভেতর রেখেছেন গুহা গুহা আরও এক গুহা আর উর্বর গূঢ়তা। সহজিয়া সাধকের মত লক্ষ্য করে যাচ্ছেন প্রতিটি গুহার ভেতর গ্রহপোকাদের অংশগ্রহণ। মৃত্যুর বাইরের এক পৃথিবীতে পরিত্রাণ খুঁজছেন মণীন্দ্র। একটি শরীর ও তার শূন্যতা থেকে একা উদগ্র দাঁড়িয়ে ‘অক্ষয় মালবেরি'র মণীন্দ্র গুপ্ত তাই আত্মার বিযুক্তির দিকে বারবার ছুঁড়ে দিচ্ছেন সেই অমোঘ প্রশ্ন-

“For what is it to die but to stand naked in the wind and to melt into the sun?

And what is it to cease breathing but to free the breath from its restless tides that it may rise and expand and seek God unencumbered?

Only when you drink from the river of silence shall you indeed sing.

And when you have reached the mountain top, then you shall begin to climb.

And when the earth shall claim your limbs, then shall you truly dance.”

রিলেটেবল থিমসগুলোকে নিয়েও তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্যে মণীন্দ্র গুপ্ত এক ধরনের না বলা কথা না বলা অন্বেষণ বা অভিজ্ঞতার জগত তৈরী করেছেন। একে আমরা কথন না বলে কথাছাঁদ বলতে পারি। যেখানে পাঠকের সামনে চরিত্রের সবটুকু আঁশ রেখে গেছেন লেখক কেবলমাত্র তার নিজের মত করে; পাঠকের কাজ সেখানে বালি পলি পালকটুকু ছাড়িয়ে প্রজন্মের ভাষা খুঁজে নেওয়া। এসব চরিত্রগুলিকে  কয়েকটা সাদা নীল ছবির ওপর আয়না বসিয়ে ইন্ট্রোসপেক্টিভ ইন্টেরোগেশন বলা যেতে পারে। এরাই যেন সেই ‘হলো ম্যান’ সেই ‘শেপ উইথআউট ফর্ম শেড উইথআউট কালার’! আর এ থেকেই তৈরী হচ্ছে যে কোন প্রান্তের পাঠকের কাছে তার স্বকীয় সাধ্যের ক্ষেত্র তৈরী করার প্রস্তুতি যেখান থেকে স্রষ্টার পাঠটিকে স্বীকার করেও পুনঃপাঠের প্রেরণায় বার বার ফিরে আসবে সে, তার নিজস্ব মায়া আবরণ তার তরঙ্গের ওঠা পড়াতে অপরসত্ত্বা খুঁজতে ফিরে আসবে পাঠক। যেমন-

১- শৈশবে নিজের মা চরিত্র- সম্পূর্ণ  চরিত্রটিকেই কিন্তু মাতৃত্বের বা মেয়েলি সমীক্ষণের বাইরে রেখে কিছুটা আনডেভলপড টোনিং দিয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। কিছুটা শূন্য করে রেখেছেন তার মূর্ত অবয়বের জগৎটাকে যেখানে দাঁড়িয়ে পাঠক নিরীক্ষণ করতে পারবে তার নিজস্ব তৃষ্ণার সংবেদনাটি। মা এবং জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের অকালমৃত্যু প্রথম স্মৃতি হলেও তাকে কিছুটা ব্লার করে দিয়েছেন লেখক, কিছুটা কাঁথা বালিশের গন্ধ আর কিছুটা বৃষ্টির গন্ধে ভিজিয়ে দিয়েছেন অমীমাংসিত এক প্লটকে যেখান থেকে পাঠক পাঠের বহুস্বরতায় পৌঁছে যেতে পারে, আর লেখকের ছেড়ে যাওয়া শূন্যায়তন ভরে যায় পাঠকের সম্ভাব্যতাতে।

২-“ঐ ঘরের মা” চরিত্র – কেবলমাত্র  একটি রান্নাঘরের মধ্যে একটি বা দুটো দৃশ্যের মাধ্যমে মণীন্দ্র গুপ্ত ছেড়ে গেছেন সম্পর্কের হাজার ফুট গভীরতা, সেখানে চেহারার কোনো প্রয়োজনই নেই বরং রিডার্স ম্যাপে ছড়িয়ে দিয়েছেন কয়েকটা অকথিত মানসিক মনোরমা, যার আকৃতি ও পরিচয় মিলিয়ে মিলিয়ে আমরা জোড়া দিচ্ছি অতিমানবিক প্রহেলিকা। এজাতীয় গঠনের মাঝে দীর্ঘ কবিতার মত তুলে রাখা কিছু সাবলীল অগঠন। চরিত্রের প্রাণভোমরা গচ্ছিত রাখা গল্পের বিশিষ্ট অজ্ঞাতবাসে, যেখানে বুকের দুধ দিয়ে নিজের ছেলের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়ানোর সাথে সাথে একদিকে গড়ে উঠেছে আশ্চর্য প্রশ্রয়, তো অন্যদিকে ঈষৎ সান্দ্র এক অপরিজ্ঞাত পৃথিবী যা পাঠকের ধারণার ওপর নির্ভর করতে করতে ক্রমাগত পর্যবেক্ষকের বির্নিমাণে প্রকট হয়।

৩- মুনশীবাড়ি –  হয়ত অনেকেই বলবেন বাড়ির মধ্যে চরিত্রের যৌক্তিকতা কোথায়! কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয় একটির পর একটি বিচিত্র ধ্বংসস্তুপ সাজিয়ে গড়ে তোলা এই মুনশীবাড়ি অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শূন্য সেই অলীক কঙ্কাল যে লাফিয়ে লাফিয়ে ধরতে যাচ্ছে একটি বর্তমানকে আর এই বর্তমানই যেন কিছুটা পড়েই অগণন লাল ফড়িং-এর ওড়া দেখতে দেখতে মিলিয়ে যাবে কোনো এক সূর্যাস্তমর্মরিত পৃথিবীর দিকে। ভাঙা দালানের শরীরী ছায়ায় পড়ে থাকবে কেবল কিছু মহাকালের সন্দেহ কিছু স্বপ্নবিক্রয়কেন্দ্র অথবা নিষ্ঠুর সবুজ এক জীবনের ছেড়ে যাওয়া কিছু সামান্য ধূসর ইতিহাস। মুনশীবাড়িকে ঘিরে এক অদ্ভুত চেতনাসূত্র ছেড়ে গেছেন লেখক, একটা থিম্যাটিক প্লুরালিজম, যেখান থেকে নবনির্মাণ সম্ভব, বিকল্পভাবনা সম্ভব। সত্ত্বার সাথে মিলিয়ে দেখতে দেখতে তার সাদা পাতার নিচের পরিব্রাজকসত্ত্বায় পৌঁছানো সম্ভব।

৪- কাঠুরে ছোলেমান –ছোলেমানের চরিত্রের বেশিরভাগটাই লিনিয়ার, সে কাঠ কাটত, তেল মেখে চান করত আর তিনজনের ভাত একা খেত-এ অবধি মোটামুটি একটা সাদামাটা সুরক্ষিত চরিত্র; কিন্তু যে মুহুর্তে কথকের মুখে বসানো হল এক আশ্চর্য সংলাপ- “নগদ আটআনা পয়সা নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে তেঁতুলতলার পথ দিয়ে চলে যেত- ঐদিকে কোথায় যেন তার বাড়ি”- সেই মুর্হুতেই পাঠকের সামনে খুঁড়ে দেওয়া হল অনন্ত মিউটেশন, ছড়িয়ে দেওয়া হল কিছু অবারিত চেতনাজিন। এখান থেকেই পাঠকের ভিসেরালে উঠে আসে একের পর এক প্রশ্ন। কোথায় তার বাড়ি ! কোথায় তার ব্যবহারিক বাস্তবের বাইরের অস্পষ্ট বসতি! এক অনন্ত অসমীকরণের সামনে মণীন্দ্র গুপ্ত একটি সপ্রাণ স্বপ্ন-সমীক্ষণের দায়ভার দিয়ে গেলেন পাঠকের কাছে।

চরিত্রগুলির মাঝে এজাতীয় ইন্টারটেক্স্যুয়ালিটি বহুবিচিত্র সম্ভাবনার ক্ষেত্রটিকে নিরন্তর সংঘাতের দিকে পরিবর্ধিত করে। আক্ষরিক অর্থ থেকে বেরিয়ে পাঠক পৌঁছে যায় আন্তর্বয়ানের অ্যালুশানে। জোনাথন কালার তাঁর ‘Presupposition and Intertextuality’ গ্রন্থে বলছেন- “The study of intertextuality is thus not the investigation of sources and influences as traditionally conceived; it casts its net wider to include anonymous discursive practices, codes whose origins are lost, that make possible the signifying practices later texts.”  অর্থাৎ একটা অনভিপ্রেত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিফলন কুড়োনো, আসল সিগনিফায়েড থেকে তার ছায়া সিগনিফায়ারের চিহ্ন ও চিহ্নিতের রিপিটেড এনকাউন্টার, আর এভাবেই মণীন্দ্র গুপ্ত জায়মান করে রাখছেন কিছু চরিত্রকে তাদের স্বগতোক্তিকে তাদের স্বীকারোক্তিকে। বহুব্রীহি ভরাটের মাঝে নিজস্ব ফাঁক রেখে ফিরে আসছেন লেখক, ফিরে আসছেন তার পাঠককে ইন্ট্রোস্পেকশনের কিছু মিহি ফ্রেস্কো দিয়ে ফুটেজ দিয়ে।

‘অক্ষয় মালবেরি’ এর দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই কেন্দ্র থেকে আবর্তিত এলাকার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজৈবনিক বুননের সুতো। শরতমেঘ আর কাশফুলের এক বন্ধু, নানা অনুমানে চলকে যাওয়া এক বালকজন্ম তার প্রত্নপ্রায়কাল থেকে তরল এক জীবনের দিকে আকর্ষের ন্যায় বেড়ে উঠেছে ক্রমশ। অতীত খন্ডজীবন থেকে অস্পষ্ট রঙের গুঁড়ো থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য এক প্রতিধ্বনিত মহাজীবন। “স্টীমার পোতাশ্রয় থেকে বেরিয়ে পড়ল…জল ফেনিল হয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে পিছনে ছুটে চলেছে…এখন আর ওপার দেখা যায় না…শুশুক ভুস করে লাফিয়ে উঠে কালো পিঠ দেখিয়ে আবার জলে পড়ে যায়।'' প্রবাসী হচ্ছেন মণীন্দ্র, তাঁর শৈশবের পিছিয়ে পড়া সারল্যগুলোর দিকে সার্চলাইট ফেলতে ফেলতে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাল্যকালের সাঁকো। জাপটে ধরতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে যাওয়া পাখিপৃথিবী থেকে উড়ে আসছে পরবাসী পালক। নিঃশব্দে গড়ে উঠছে একধরনের ফিলোজফিকাল কোয়েস্ট। তাঁর কাত্তিক কাকার বউ, তাঁর লক্ষীপূজো তাঁর নবান্ন তাঁর এজমালি বাড়ি তাঁর কাঁচা শরীর কিংবা বিস্তীর্ণ দেশে বহু দূরে দূরে পেটা ঘণ্টারা কি শেষবারের মত নোঙর টেনে দিল ? স্মৃতির অন্ধকার পেটে আঁচড়ে দিল ঈষৎ ছায়াভ নখ দিয়ে ? এ প্রশ্ন যতটা না প্রার্থিত তার থেকেও অনেক বেশি অনন্যসম্ভার হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত হয়ে উঠেছে বাল্যের দুর্মর কল্পনালোক থেকে বেরিয়ে চর্চিত চৌহদ্দীর বাইরে আকস্মিক এক পৃথিবীর অভিজ্ঞতার শরিকায়ানা নিয়ে মণীন্দ্রের এই নতুন অনিশ্চিত ভেসে যাওয়া। ব্যক্তিগত স্তর থেকে তিনি যেন ধীরে ধীরে বৈশ্বিকসত্ত্বায় দ্যোতিত হচ্ছেন এবার। বিংগ ইন কমন থেকে বিংগ ইন দ্য ওয়ার্ল্ডের দিনপঞ্জী লিখছে ক্রমবিকশিত এক নাবিক শরীর। চিরন্তন অস্তিবাদের স্লাইসগুলো ক্রমশ হয়ে উঠছে তাঁর জীবনদর্শনের আবিষ্কার। ওপার বাংলার গৈলা গ্রামে যে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর বাস্তু, এজমালি আর ভাঁড়ার নিয়ে ভাঙামাঠের মন্ত্রগুপ্তি খুঁজে চলেছিলেন, কাছাড় উপত্যকার নতুন জীবনে এসে সেই মানুষটার চোখেই যেন আকর্ষী উন্মুখ হয়ে ধরা দিল শিববাড়ির সাধু-গৌরদাস বাবাজী-কৃষ্ণসাধু-সাধু দিদি-বাটঠি মৌলবী-কুঞ্জলতা-নাটাই মঙ্গলচন্ডী, নাগা ও মনিপুরী মেয়েরা অথবা মান্ডিসাহেবের মত একাধিক ব্যঞ্জনায় তাড়িত চরিত্র। ‘আমি’ থেকে আতসকাঁচ ফেলা হল পরিধীহীন মানুষের সমস্তটুকুতে। এই কি সেই  বিশ্বতাড়না ? ব্যক্তিগত মনোনয়নের কাহিনীকে পেরিয়ে যাওয়ার গল্প ! হাইদেগার তাঁর ‘বিংগ এ্যন্ড টাইম’ এ যেমন বলছেন- “The closest world of everyday Da-sein is the surrounding world. Our investigation will follow the path from this existential character of average being-in-the-world to the idea of worldliness as such.We shall seek the worldliness of the surrounding of world by way of an ontological interpretation of those beings initially encountered within the surroundings …..The phenomenological exhibition of the being of beings encountered nearest to us can be accomplished under the guidance of the everyday being-in-the world, which we also call association in the world with inner worldly beings….”। অর্থাৎ আত্মসত্ত্বা থেকে বিশ্বসত্ত্বায় সংশ্লেষিত হয়ে যাওয়া। তাঁর ব্যক্তিক আমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক বেশি জাগতিক বর্হিদেশে সংলগ্নতা খুঁজেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত আত্মজীবনীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে এবং সেখান থেকেই অনুসৃত হয়েছে ইউনিভার্সাল মেকানিজমের বয়নগুলি। তাঁর স্বঅন্বেষণের স্বার্থকতা এখানেই, অকিঞ্চিৎকর থেকে অস্পর্শ অবধি গ্রাফিক নকশা টেনে দিতে পেরেছেন অনায়াসে। উঠে এসেছে সময় ও সংস্থানে গেঁথে থাকা কিছু অ্যালিয়েনেটেড ম্যান যারা এক সামগ্রিক কালচেতনারই সংকরায়িত পুঁজি, যারা ক্রমাগত জিজ্ঞাসিত কিছু পার্থিব কায়া। কিছু স্নায়ুচাষ থেকে উঠে আসছে কিছু সাইকোলজিকাল ডুয়ালিজম। ঠিক এ জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা লক্ষ্য করতে পারি তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে মানুষের চারধারে মানুষ, নুয়ে পড়া মানসিক মৌঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ তামস কিছু পিচবোর্ডের মানুষ উঠে আসছে মণীন্দ্র গুপ্ত নামের কোনো এক ছবিকরের তুলিতে। চরিত্রগুলির আন্তর্বয়ান চিহ্নিত করছে আর্ন্তবয়নের দ্বৈততাকে। যাদের কথন অকথনে ছড়িয়ে থাকা দুটি ভিন্ন পৃথিবী দুটি খন্ডবীজ দুটি ডিসিমিলার ভ্যারিয়ান্ট ক্রমাগত খুঁজে চলেছে মানবমনের সহজ তরলতা, খুঁজে চলে ঘন গভীর অতিরিক্ত। যেন চরিত্রের সাথেই চরিত্রের কাঠামো বদলের লড়াই চলছে ক্রমাগত। দিনের পর দিন এক নির্জন দার্শনিকের মত চরিত্রদের দেহ মনের গাণিতিক অসন্তোষ লিপিবদ্ধ করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। একটা rational chain একটা গূঢ়ৈষা যা ক্রমশঃ চিহ্নিত করছে সমান্তরালে অবস্থিত দুটি ভিন্ন বাস্তবতা। কার্টেশিয়ান মেটাফিজিক্সের মাধ্যমে দের্কাতে বলতে চেয়েছিলেন এই দৃশ্যমানের ভেতর আসলে একটা ‘আমি’ আছি আর আছে এক ‘ধারণা’ একটা ‘ইচ্ছে’, অর্থাৎ ফিজিক্যাল রিয়েলিটি ও মেন্টাল রিয়েলিটি- দুটো ভিন্ন ধারণা, ডুয়ালিটি, ডিভিশন, ডায়াকটমি এবং সর্বোপরি দুটো ভিন্ন প্রত্যক্ষতা দুটি ভিন্ন সত্ত্বা, যা কখনও মেলবার নয়। যা বহুত্বের মিশ্রণেও কেবল মামুলি ব্যর্থতার হয়ে রয়েছে। একদিকে জগৎস্থিত সত্ত্বার প্রত্যক্ষ সাংগঠনিক রূপ, ইচ্ছা অনিচ্ছার রূপ আর একদিকে চেতনার রূপ পরার্থের রূপ। অস্তি দুজনের কাছেই ঋণী দুজনের কাছেই অকারণ মাথা খারাপ করে বসে আছে অথচ দুজনের মাঝে অজান্তেই গড়ে উঠছে একটা আনব্রিজেবল গালফ একটি শেওলাসমগ্র যা কখনই সীমানাদুটোকে মিলিয়ে দিতে পারছে না। আমরা স্বপ্নের কাছে আসছি উপচিত্র আঁকছি অথচ একটা সমগ্রতা কিছুতেই চিরকালীন হতে পারছে না। কার্টেশিয়ান সাইকোফিজিকাল ডুয়ালিজমের মাধ্যমে দের্কাতের থিংকিং সাবস্ট্যান্স আর ফিজিক্যাল সাবস্ট্যান্সের মাঝেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি মণীন্দ্র রচিত সেই রোগা লম্বা কালো পোশাক পরা সালভাদর দালির মত গোঁফওলা ম্যাজিসিয়ানের বউকে যিনি আয়তক্ষেত আর ট্রাপিজিয়মে ভরা এই পৃথিবীতে আস্ত ছাগলের জিভ গিলে নিয়েও হাসছেন মিথ্যে এক জাদুপৃথিবীর দিকে তাকিয়ে, অনুমোদন খুঁজছেন ভোজবাজির পার্থিবে। যেন এক মহাশূন্যের বাতাবরণ অথচ তারই ভেতর কান্না আর কাঁপুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তাঁর যাত্রাপথের কাহিনীতে লুকিয়ে থাকা চরিত্রগুলোর মধ্যে মণীন্দ্র গুপ্ত এভাবেই খুব সহজ়ে বিশ্লেষণ করেছেন দেহ এবং আত্মার মাঝের দ্বৈততা, চলমান স্পন্দনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ইনফিনিট স্পিরিচ্যুয়াল বিংগ-এর সাথে চুক্তি, সমঝোতা। গতিচেতনার মানুষগুলোর সাথে তাদের ধীর অন্তর্লোকের এক চিরপরিচিত বিরোধ, যা বেঁচে থাকার মধ্যেও বিশ্বাসী করে তুলছে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এক অবিশ্বাসী আশ্রয়ের প্রতি। ‘অক্ষয় মালবেরি'র প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের কিছু চরিত্রকে সারণীবদ্ধ করে আমরা চরিত্রগুলোর মধ্যে খুঁজে নিতে পারি ব্যবহারিক জীবনের এতসব খন্ড চৈতন্য, যা আড়াল থেকে চরিত্রের মাঝে লুকিয়ে থাকা আরও এক আর্ন্তচরিত্রের সংযোজনা করছে। জীবন ছাড়িয়ে তো সাহিত্য হওয়া সম্ভব নয়, সে তো গভীরভাবে অবদমিত কিছু মানসপ্রক্রিয়ার সংকারয়নেই তৈরী, তার সামনে থাকে একটা লম্বা দৌড় আর পেছনে পড়ে থাকে আরও এক দীর্ঘ স্বপ্ন আর এই অনূদিত জীবনের সাথে অননূদিত জগৎটাকে, থিতিয়ে থাকা এককটাকে তাঁর আত্মজৈবনিক কথনে মণীন্দ্র গুপ্ত কোথাও যেন ধীরে ধীর উন্মোচন করতে পেরেছেন অনায়াসে:-

চরিত্র
ফিজিকাল/রিয়েল ইম্প্রেশন
মেন্টাল ইম্প্রেশন
কুঞ্জদিদি
চিঠি নিয়ে দুটো ঋতু চলে গেল। কিন্তু কুঞ্জদিদির স্বামী এল না…… সারসীর মতো কুৎসিত পাউঁচু কপাল, রোগা লম্বা গলাতেমনি থমকে থমকে চলাতাকে লোকালয়ের চেয়ে নদীতীরেই বেশি মানায়। ক্রমশ সে আর মানুষের চোখে পড়ে না। 

স্বামী ফিরে আসবে দাদা বৌদির আশ্রয়ে আশ্রিতা এক নারী যার একমাত্র স্বপ্নের রসদ তার স্বামীর প্রত্যাবর্তণের অপেক্ষা। কথককে দিয়ে বারংবার চিঠি লিখিয়েছে সে, আঁচলে লুকিয়ে রেখেছে একমাত্র স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে।
কার্তিক কাকার বউ
যুক্তি বুদ্ধির বাইরে এক সরল গ্রাম্যবধূছোট্ট ছিপছিপে কালোসবুজ  এক চরিত্র যার কাছে সত্য বলতে তার শহুরে স্বামী তার অন্দর তার সাবেকি সাংসারিক স্বতঃস্ফূর্তি ….
অথচ বাস্তবে শহরের স্বামীর দেওয়া সিফিলিসের শিকার তিনি। তার জীবন ক্রমশ পাঁশুটেধূসর লাল। গোপনীয়তার জন্য তার আশ্রয় সংসার না হয়ে ছায়ায় ভরা গভীর বন হয়ে ওঠে। শরীর পিষে নেওয়া এক আঠালো যন্ত্রণার মাঝে তার খসখসে উরু চুলকোয় এক তৃষ্ণার্ত স্বপ্ন ;
কার্ণিভালের খেলোয়াড় মিঃ পি সি পাল
দুঃসাহসিক এক খেলোয়াড়। আশি ফুট ওপর থেকে যিনি গায়ে আগুন লাগিয়ে ঝাঁপ মেরে দর্শককে তাক লাগিয়ে দিতেন।  তাঁর গুরুত্বহীন স্মৃতিছবিগুলোতে আলো ফেললেই বোঝা যায় ভয়কে হারিয়ে দেওয়ার, সমাজকে হারিয়ে দেওয়ারমামুলি মৃত্যুকে হারিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী চেতনা দিয়ে তিনি শরীরের ছবি এঁকেছেন, যেন এক অন্যজগতের মানুষ , জীবনই যার কাছে একমাত্র ঝুঁকি। হু হু শীতের বাতাসে জ্বলন্ত মশাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই যার কাছে অন্ধকারকে হারিয়ে দেওয়ার একমাত্র আখ্যান।
মাস তিনেক পরে খবর পাওয়া গেল কোথায় যেন খেলা দেখাতে গিয়ে পি সি পাল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চৌবাচ্চার কিনারায় পড়ে দু আধখানা হয়ে গেছেন। অথচ জীবনের জন্য কাকেই বা তিনি দায়ী করবেন! স্মৃতির বাইরে এই তার সহজাত ডায়ানাস্টি যেখানে মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি নেই, নিষ্কৃতি নেই যাপনের অনিবার্য যন্ত্রণা থেকে। ইনফিনিট ফ্রিডমের বাইরে আসলে মরজগতের কষ্ট যন্ত্রণা আর মৃত্যুতেই সে মহিমান্বিত। সমস্ত কার্নিভালে এ যেন এক একক মানুষের উদ্বৃত্ত খোলামকুচি …
বৈষ্ণবীদিদি
বিধবা মানুষমধ্যবয়সিনীসংসারে কেউ নেইকেবল সন্তানের মত কোলে করে আনতেন কাঠের গৌরাঙ্গরাসপূর্ণিমায় গেয়ে গেয়ে শোনাতেন  দুঃখসুখ শূন্য এক ছায়াবৎ জগতের কথা এক নিটোল ঈশ্বরচেতনার কাছে তিনি যেন অসাড় থাকার অভ্যেস করছেনউপকরণহীন   থাকার অভ্যেস করছেন।
কিন্তু কি সে জগৎ ঈশ্বরের অধিকারের কাছে এসে সে কি অস্তিত্ববাদী মানুষের বিফল নিবেদন নয় প্রৌঢ়দিনের সাদা শাড়ি পরিহিতা এই নিবৃত্তরজস্কা মহিলাকে ঘিরে ঘিরে যে সাদা কুয়াশাতার চারপাশে কেবল এক বেঁচে থাকার স্বপ্নচক্র, চোখ বুঝে আসা সর্বত্র পরম শূন্য।

ম্যাজিশিয়নের বউ
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেই দেখা যাবে এ জাতীয় চরিত্রের সাথে সবসময়ই দু একটা সাদা কালো কনট্রাস্ট জড়িয়ে   রয়েছে। জীবনের লৌকিকে দাঁড়িয়ে প্রাত্যহিক  ধূপশহরে দাঁড়িয়েও যেন একটু জিরিয়ে নেওয়া, রিয়ালিস্ট জাদুর অগাধ ছায়ার নিচে স্বপ্নের কিছু অলক্ষ্য হিজিবিজি দাগ কাটা। সবকিছুই এক ঝলমলে অপ্রমাণ অথচ চিৎকারকে স্তিমিত করে জাদুকর বা তার বউ যেন রোদাক্রান্ত যাপনেও পরিতৃপ্তি খুঁজছেনখুঁজছেন ধারাবাহিক জোনাকির প্রলাপ।
কেবল এক ইচ্ছাপূরণের অলীক প্রত্যাশাদু চামড়ার মধ্যে নেতিয়ে থাকা শীতকে যেন বারবার রক্তশূন্য হাততালির মাঝে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। পৃথিবীর মত এক অস্থায়ী মঞ্চে ম্যাজিশিয়নের বউ তার যাপনের জন্য ছাগলের কাটা জিভও যে অতিকষ্টে গিলে ফেলছেন তা যেন বারবার মনে করায় উপরের হাসির তলায় লুকিয়ে রাখা প্রয়োজনভিত্তিক এক বেঁচে থাকা। যেন পথে পথে ছড়ানো অন্ধকার আর নিজেরই অন্ধকারে ভিজিয়ে রাখা জীবনের জলপাই রঙের পাথরগুলো।

'অক্ষয় মালবেরি' কে কেবল আত্মজৈবনিক উপাখ্যানে চিহ্নিত করার অর্থ তার আপতিক আলোর বাইরে তার নিদাঘ আঁধারযাত্রার বাইরে যে বিস্তীর্ণ জীবনের সারসংকলন, জন্মউৎস থেকে মুক্তজীবনের অনন্য যাপনপ্রণালী তাকে কোথাও পৃথক করা। আসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মণীন্দ্রীয় স্মৃতির আড়ালে রয়ে গেছে এক বিরাট মানুষ, এক বিশালদেহী ভ্রমণবৃত্তান্ত। তাঁর রাজ্যপাটে একদিকে পরিত্যক্ততা আর অন্যদিকে দূরবীন বসানো শৈশব যেখানে কল্পলোকের পিঁপড়েদের এই জগৎসংসারের ধৃকেন্দ্রের এক মীমাংসাহীন খোঁজ। ‘আশ্চর্যদ্বীপের মাটি মেখে’ সারারাত তাঁর নৌকারা চুরি হচ্ছে যন্ত্রণা নিয়ে দৌড় নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে স্তুপ স্তুপ জন্ম মৃত্যু নিয়ে কিংবা কেবল কিছু জন্মদিন নিয়ে। অনেক দূর থেকে দেখছেন মণীন্দ্র গুপ্ত, চাঁদের ওপিঠ থেকে এদিকের ‘শরীর ভরা চাপকে অকস্মাৎ মুক্ত করে দেওয়ার’ এক আধিদৈবিক দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। হ্যাঁ আধিদৈবিকই বটে, বস্তুর ওপরের বাষ্পটুকু হয়ে উঠছে মণীন্দ্র গুপ্তের অমোঘ বরাদ্দ যা দিয়ে এই স্বাভাবিক সংসারযাত্রার মাঝে এই চিরকালীন নির্যাসের মাঝেও তিনি খুঁজে নিচ্ছেন অনুভূতির সমান্তরালে এক অপ্রাকৃত ভাষা; সেখানে মহীরাবণের মত হয়ে উঠছে গোলআলুরা, গভীর চোখের তারার মত হয়ে উঠছে বেতফলেরা কিংবা নিছক ঢেঁকিশাক সেখানে দুলে দুলে পড়ছে পৃথিবীর সবুজ অলংকারের মত। আর এভাবেই সাহিত্যের প্রবাহিত সিলেবাসের বাইরে তিনি তালিম দিয়েছেন দ্বিতীয় ভুবনটিকে, আর সেই তাঁর জীবন ঘষে ঘষে বের করে আনা জায়মান প্রতিনন্দন। বেশ খানিকক্ষণ একটানা ‘অক্ষয় মালবেরি’ পাঠের শেষে পাঠকের মনে হতেই পারে সে কোনো স্বপ্নের মধ্যে আছে, বেরোতে পারছেনা একটা ঘোর থেকে, খুব জোর দৌড়েও  পেরোতে পারছে না আর কখন অজান্তেই তার বালককাল পাতার আগুন পোহাতে গোল হয়ে বসেছে মণীন্দ্র পাশেই। ব্যবহারিক জগতের থেকে বেরিয়ে এসে কোনো এক গুপ্তজীবনের দিকে প্রাগৈতিহাসিক ভাপের দিকে তাঁর স্বরলিপিরা পাঠককে কুড়োতে দিয়েছে এমনই সব পাখির ভাষা মাছের ভাষা গুহ্য ভাষা। এই তাঁর ‘অনন্তকাল’, এক মহাযাত্রিকের ‘অনন্তকাল’ যে অঙ্কুরিত হয়ে মেটে তেল আর গাবের আঠায় মাজা কুচকুচে কালো গলুইয়ের শরীরে ভেসে চলেছে অপ্রকাশিত জগতের দিকে। সরাসরি জীবন থেকে তৈরী করা জগৎকেই একমাত্র পাথরে খোদাই করে না রেখে পাশাপাশি রেখে দিয়েছেন কল্পনার মোম মেশানো কিছুটা অনুভবের তার্পিন যা একটু ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে নিলেই পাঠক পেয়ে যাবে প্রতিপাঠের মোলায়েম ভার্নিশটি। সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের সাথে একদা সাক্ষাৎকারে তাঁর কবিতায় গল্পে একটি স্তরে প্রাত্যহিক-সাংসারিক জীবন, আর তার পরই উঠে আসা এক অলৌকিক জীবনের প্রশ্নে মণীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন- “আমার অনেক দিন ধরে মনে হয়েছে এই যে আমরা চোখের সামনে জগতের দৃশ্যমান, ঘটমান স্তর দেখছি এরই সমান্তরালে জগতের আর একটি স্তর সমানভাবে বয়ে চলেছে। সে স্তরটি আমরা দেখতে পাই না- কিন্তু মধ্যে মধ্যেই তার ক্রিয়া এসে আমাদের নিশ্চিদ্র বাস্তবতার উপরে সপাটে পড়ে তাকে কিছুক্ষণের জন্য ব্যাখ্যার অতীত করে চলে যায়। যতক্ষণ স্তর দুটো একটু ফাঁক রেখে সমান্তরালে চলছে ততক্ষণ হয়ত কিছু স্থূলভাবে অনুভব করিনা। কিন্তু যখন স্তর দুটি কোনো অজ্ঞাত আলোড়ণে কনভেক্স হয়ে পরস্পরকে স্পর্শ করে তখন অপ্রাকৃত একটা কিছু ঘটে।'' আপাত দৃশ্যের বাইরে সেই অপ্রাকৃত কে আঁকড়ে ধরার তাড়না আমরা মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজৈবনিক উপাখ্যানেও লক্ষ্য করতে পারি যা একটি আত্মজীবনীকে বহুস্তরীয় ধ্রপদী গড়ন দিয়েছে।

বারবার মাটি ছেড়ে যাচ্ছে ঝুরঝুরে মানুষগুলো, কম্পোজ্ড সয়েলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের কাঁথাশিল্প। আর এই অস্তিত্বগুলোর রূপান্তরিত হবার নিজস্ব ধর্মকেই তিনি বলছেন ‘কাল’। না থাকার মত করে যে থাকে শূন্যতা ভরে তাকেই তিনি বলছেন ‘কাল’। সময় ঘনীভূত ভাবে ঠাসা এখানে- সময় নির্লিপ্তভাবে সওয়া এখানে। ‘যেন এক নশ্বরের ছায়া……স্বাদ নিতে না নিতেই ফুরিয়ে যাওয়া’। হয়ত এই কালকে ধরতেই ষাটোর্ধ্ব মণীন্দ্র হামাগুড়ি দিতে দিতে ঢুকে পড়েছেন হলুদ অপসৃয়মানের মধ্যে। হ্যাঁ, এক আশ্চর্য বিস্ময়বোধকেই খুঁজে পেতে চাইছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। পরিত্যক্ততার যন্ত্রণার উপর দাঁড়িয়েও প্রবাহের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে রিফু করা অন্য এক মণীন্দ্র। একদিকে মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন- “ঐ উপত্যাকার সঙ্গে যে আমার বন্ধন হল না তার আসল কারণ এখন বুঝি আমি ওখানে ছিলাম পরবাসী, পরভৃত। আর সেদিক থেকে, এই জীবনের শেষে, মনে হয়, এই পৃথিবীতেই আমি পরবাসী এবং পরভৃত''। আবার অন্য দিকে আমরা লক্ষ্য  করছি তাঁর আত্মজীবনী প্রথম বাইশ বছরের শরণার্থী হয়ে উঠছে, তার আদুরেপানা তার অপ্রাপ্তবয়স্কতাকে সম্প্রসারিত করতে চাইছেন না মণীন্দ্র গুপ্ত, তিনি যেন একলা পড়ে আছেন কোনো ‘অনতিচ্ছদ আদিভূমি’তে। নদীর কালো জলে বাঁশপাতা মাছের প্রথম শ্বাসের কাছে। প্রভাময় পতংগের মত গাছের প্রথম কিছুটা আলো যেখানে। শৈশবে মাতৃহীনতা কিংবা সংসার-বৃত্ততা থেকে দুলে দুলে উদ্ধৃত্ততায়, অসম্পূর্ণতায় কোথাও যেমন পরবাসী করে তোলে তেমনিই এই সার্বিক বর্জনই হয়ে উঠেছে তাঁর জীবননির্মাণের বর্ণিল আবহাওয়া। যে প্রতিকূলতায় দাঁড়িয়ে তাঁর নীড় গঠন, যে নীরব অভাবে তাঁর শৈশবের ভাস্কর্য্য তৈরী, জীবনসায়াহ্নে তারই ভাষা বুঝতে চেয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত। তবে সে কেবল ঋজু রৈখিক অসহায়তার কথা নয় বরং ফেলে আসা জীবনতারিফ নিয়েও ডুব দিয়েছেন তিনি সেই ঢেউভাঙা সমুদ্রে যার কাছে আর কোনোদিনও ফেরা হবে না। 'অক্ষয় মালবেরি'র একাধিক দৃশ্যে যে বাল্যজীবন ধরা পড়েছে তাতে নিম্নবিত্তীয় তথা মধ্যবিত্তীয় ন্যারেটিভটি উত্তোরত্তর সৃজ্যমান হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলির মাইক্রো ন্যারেটিভে ধরা দিচ্ছে অভাবের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। কোজাগরী লক্ষী পূজোর রাতে সেখানে মণীন্দ্র গুপ্তকে বলতে শোনা যায়- “সোনার গয়না পরা, বালুচরী শাড়ি পরা সেই দেবী কিশোরী কখনই আসবেন না আমাদের বাড়ীতে। আর যদি বা আসেন, তেঁতুলতলা দিয়ে আসতে আসতে তাঁর পায়ে ধুলো লেগে যাবে। পশ্চিম পুকুরপাড়ের রাস্তায় অন্ধকারে তাঁর গয়না হারিয়ে যাবে, আমাদের বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছবেন, তখন তাঁর শাড়ি ছোটমার শাড়ির মত ময়লা।'' জীবনের দীর্ঘায়ত দুপুর হেলে গেলেও সেই শেকড়টিকে উৎসটিকে মণীন্দ্র যেন আজও ভোলেননি, ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছেন লোককথা আর স্বপ্ন আশ্রয়ী সেই সাধারণ জীবনটির সঙ্গে। ওমনই একটা জায়গায় মণীন্দ্র গুপ্ত আজও যেন বসে আছেন কাদা পায়ে ম্লান ও নিঃশব্দ পৃথিবীর কোনো এক বৈকালিক আড্ডার সাক্ষী হয়ে। পেট্রোম্যাক্স, কারবাইডের আলো, কেরোসিনের ডিবে কিংবা বিড়ির আগুন সবই তো নিভে যায় কিন্তু নেভে না স্মৃতির দহন; আর তাই জীবনের তুমুল কেনাবেচার শেষে যেখানে হাট ভাঙে সেখান থেকে ‘অক্ষয় মালবেরি’ স্মৃতিসজল পরিত্যাগকে হলুদ আর সাদা মেশানো এক নতুন প্রস্তুতির মতই স্বীকার করছে। ফেলে আসা বাল্যের শৈশবের কৈশোরের হাত জড়াজড়ি করে মণীন্দ্র গুপ্তও যেন ‘অক্ষয় মালবেরি’র সমস্তটুকু জুড়ে রয়েছেন অপূর্ণতাকে স্পর্শ করে কিংবা ক্ষণজীবনের পূর্ণতা ছুঁয়ে দেখতে...

যেকোনো একটি আত্মজীবনীর  মধ্যে লেখকের এমন স্বয়ং পুরোধা হয়ে ওঠার সাথে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের উক্তিটি। তিনি মনে করতেন-‘An author in his book must be like God in the universe, present everywhere and visible nowhere”। ‘অক্ষয় মালবেরি’র আয়তন ও গভীরতা জুড়ে মণীন্দ্রও তো এমনিই লং শট হয়ে রয়েছেন তাঁর মূল চরিত্রের সাথে অনেকগুলি চরিত্রকে একসাথে ধরে- অতি গভীর অতি সূদূর একধরনের মিজ-অঁ-সেন তৈরী করেছেন যেখানে মিলিয়ে মিশিয়ে চরিত্রটা আবহরা মিথস্ক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। লেখক সব জায়গায় আছেন আবার লেখক যেন কোত্থাও নেই, তিনি যেন নিজের দৃশ্যকল্পনা, সংলাপ, নির্বাচন আর মনস্তত্ত্বের কাছে পাঠককে বসিয়ে রেখে গেছেন। এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে আদর্শ আত্মকথায় ঠিক কতখানি জুড়ে থাকবেন লেখক? কতখানি কৌতুহলশূন্য রাখবেন কথক নিজেকে ? পাঠকের প্রশান্তিকে স্বীকৃতি জানাতে লেখক তার অলৌকিককে লৌকিকে মিলিয়ে দেবেন ঠিক কতখানি ! কমল চক্রবর্ত্তীর প্রশ্নের উত্তরে মণীন্দ্র গুপ্তকে বলতে শোনা যায়- “জন্ম থেকে জগতকে আমি পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছি, আর তার বিচিত্র অর্থ মনের মধ্যে উঁকিঝুকি দিয়ে গেছে। নিজে নিজে একা একা এইসব নিয়ে কথা বলি। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই কথা বলাটাই আমার কবিতা। জগতকে দেখি আমি কালস্রোতের মধ্যে- কখনো উদাসীনভাবে বহমান, কখন অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের আলাদা আলাদা ঘরে স্থাণু। যতদিন বাঁচি, তার সংগে আমার সংযোগ, সংগম, সম্পর্কের আশ্চর্য কথা বলে যাই। মনে হয়, আমার জীবনের সম্পূর্ণ অসার্থকতার মধ্যে, শেষ পর্যন্ত, এইটুকুই সার্থকতা। আমার কবিতায় নিজের চেয়ে পৃথিবীর কথা বেশি। ভাষা ক্রনিকল-এর ভাষার মতো- গদ্য, কথ্য, সংস্কারহীন, ঘনিষ্ঠ।'' এই সামাজিক অনুরণন আছে বলেই, প্রকৃতির সাথে পংক্তির সহবাস আছে বলেই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার ভাষা গদ্যের ভাষা আত্মজীবনীর ভাষা হয়ে উঠেছে পাঠকের আত্মজৈবনিক উচ্চারণ। তার আবছা বীক্ষণটি পাঠকের কাছে অস্তিত্বের অতিক্রান্তির কোনো পেরেনিয়াল ফিলোজফি নয় বরং হয়ে উঠেছে সাধারণের আলোকিত বয়ান। প্রচ্ছদের ভেতরের ছায়াকে ধরে ফেলছে প্রচ্ছদের বাইরের মানুষগুলো, 'গ্রীষ্মের তাপে শুকিয়ে মুচমুচে হয়ে যাওয়া' মানুষগুলো মণীন্দ্র ওই শব্দ-বাড়ির ভিত খুঁড়ে পেয়ে যাচ্ছে নতুন মরফিম। আর শব্দ কেন ! সম্পূর্ণ ‘অক্ষয় মালবেরি’কে কোথাও কোথাও নিঃশব্দের কথকতা বলা যায়,  যেন কেউ বলে গেছে এই জগৎ আর জন্মান্তরের মাঝে চুপ করে বসে থাকতে, এই নির্মাণের মধ্যে সংলাপের মধ্যে শব্দকে স্বর দিয়ে নয় বরং চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে। সরবতাকে চিহ্নিত করতে তার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়ানো নীরব একক ঘন গহন এক নিভৃতি দিয়ে। ‘What is literature?’ এ সার্ত্রেকে আমরা বলতে শুনি- “Let Words organize themselves freely and they will make sentences, and each sentence contains language in its entity and refers back to whole universe. Silence itself is defined in relationship to words, as the pause in music receives its meaning from the group of notes round it. This silence is a moment of language; being silent is not being dumb; it is refuse to speak, and therefore to keep on speaking”। হ্যাঁ, এই না বলা কথা নিয়েই দলছুট মণীন্দ্র গুপ্ত তীক্ষ্ণ চিৎকারের পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এসে কোথাও যেন এক অন্য অভিনিবেশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।শেকড় থেকে একা একা বেরিয়ে পড়ছেন শূন্য যোগ করে করে। এরকম নিঃশব্দের ভাষা, নৈঃশব্দের অঙ্গীকার ‘অক্ষয় মালবেরি’ তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যার ওপরে ঘন কাদার স্তর জমিয়ে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে চোখ বুঝে নেমে গেছে জল আর শরীরহীন ‘আমি’ নিয়ে শুয়ে আছে এক ঘুমন্ত লেখক। ‘সসীম শব্দ দিয়ে অসীম বাক্য গঠনে’ই লুকিয়ে রয়েছে ‘অক্ষয় মালবেরি’র অপর স্বর। আসলে লেখক নন প্রতিটা চরিত্র আর চরিত্রের নিজস্ব অনুভূতিগুলোই, নিরবসান জেগে থাকাগুলোই শব্দ থেকে ছিটকে বেরিয়ে শব্দের অধিক হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলিকে তিনি একটা অন্তঃর্বিক্ষোভের অভিমুখী করতে চেয়েছেন। তাঁর কথকঠাকুর তাঁর কুঞ্জদিদি, রাধু ঘোষের বউ কিংবা শশী কর্মকারের দিদি, অথবা কাঁচাপাকা চুলের গোছায় ঘেরা ধূসর অস্পষ্ট মুখের অজস্র কাটাকুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্য কর্মকারের মা-র মত চরিত্রগুলি স্পষ্টতার পিছনে ধরে রেখেছে আরও এক অস্পষ্ট পরিচয়। যা খালি চোখে দেখছি তার বাইরেও কোথাও রয়ে গেছে অন্য এক স্বীকারোক্তি। যেমন ধরা যাক ‘কার্তিক কাকার বউ’ চরিত্রটি, সংলাপের আড়ালে যে গড়ানো নৈঃশব্দ, একা হয়ে যাওয়ার যে মুক্তমঞ্চ যে খামোশী তাকে আমরা সংলাপের অধিগঠন বা অধোগঠনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি :-

এরকম একাধিক চরিত্রকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায় যারা শব্দের শারীরীক তর্ক পেরিয়ে বোধের সফলতায় মিশে গেছে। এক বুদবুদ-সমগ্রে ভরা গেরস্থালি মণীন্দ্র, যার চারিদিকে অসমান মাপের ঢেউ আর মাঝে হাত তুলে তুলে সাঁতরাচ্ছে পুতুলের মত মানুষেরা, পাড়ের সন্ধান করছে তারা, আর মণীন্দ্র গুপ্ত সন্ধান করে চলেছেন সেই অলীক আয়নাটিকে, যা দিয়ে ঠিকঠাক দোলাতে চাইছেন জীবজগতের এই অন্তহীন সন্তরণ এই অবাধ বিচরণশীল ছবিটাকে। ‘অক্ষয় মালবেরি’কে তাই কেবল একটি মানুষের আত্মজীবনীতে গন্ডিবদ্ধ না করে সেখানে পাওয়া যেতে পারে প্রবাহিত  মানুষের প্রবাহের স্তরপরম্পরার জটিল বুনন। 

সাহিত্যের অসীম সম্ভাবনার স্বীকৃতি দিতে ডেরেক অ্যাট্রিজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমরা জাঁক দেরিদাকে বলতে শুনি, আমাদের সামগ্রিক অস্তিবাদের উর্ধ্বে এক সর্ববিমুক্তির দর্শন এই সাহিত্য, যাকে কোনো সংজ্ঞাতে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, সৃষ্টি স্থিতি লয় যুক্তি এত কিছু চিরাচরিতের বাইরেও কোথাও সে খিড়কি দরজা খুলে রেখেছে জীবনসত্যের নিরপেক্ষে পৌঁছতে। বৈজ্ঞানিক দার্শনিক কিংবা কথিত ইতিহাসে তাকে কখনই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখা করা সম্ভব নয়, বরং সে কোথাও সেই হারানো ছেলে যার জন্য জীবনসন্ধানের মাঝেই এক সহজাত দৌড়সন্ধান রয়েই যায়, সেখানে এসে পাঠক লেখক স্বরান্তরের শেষেও যেন এক প্রবাহমানতা। “Experience of being, nothing less, nothing more, on the edge of metaphysics,literature perhaps stands on the edge of everything, almost beyond everything,including itself. It’s the most interesting thing in the world, may be more interesting than the world, and this is why, if it has no definition, what is heralded and refused under the name of literature cannot be identified with any other discourse. It will never be scientific, philosophical, conversational.”। জীবনীমূলক গ্রন্থ বা আত্মজৈবনিক উপাখ্যান শিল্পীর স্রষ্টার বায়োগ্রাফিকাল এলিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও তার মধ্যেই ব্যক্তিমন থেকে পাঠকমনে প্রভাবিত হওয়ার পরিচালিত হওয়ার অনুপ্রাণিত হওয়ার একটা ভাষা অথবা ভাষাহীনতা কোথাও গভীরভাবে বিজড়িত থাকে। সেক্ষেত্রে চিন্তন হয়ে ওঠে ‘চিত্রকরের নিজস্ব রচনা’, ছবির মতই সে কেবল পালিয়ে যাওয়ার দিকেই পা পাতে আর জন্ম ও জীবন থেকে চুঁইয়ে আসা লেখকের ব্যক্তিগত স্বদেশও তখন বেড়ে উঠতে থাকে এক সূদূর প্রসারনের দিকে। আত্মজীবনীকার যখন মাপতে থাকেন তার স্মৃতি বিস্মৃতির নীল আত্মীয়তা মাপতে থাকেন যাপনের ঘনিষ্ঠ মর্মর তখন ভাষা তাকে নিয়ে চলে অন্য এক অনন্ত কল্পলোকে। হিস্ট্রির গায়ে উঠে পড়ে কিছু হিস্টেরিয়া কিছু শৈল্পিক হিপনোটিজম। স্মৃতির মানুষটাকে খুঁজে পেতে নেমে পড়ে শিল্পের আগুনে। আর ধোঁওয়া বেড়ে ওঠে। এই ধোঁওয়াকেই পাঠক পরিশীলিত করে তোলে তার নিজস্বতা দিয়ে। আর এখান থেকেই স্মৃতির একচেটিয়া প্রভুত্ব থেকে ছড়িয়ে গিয়ে আত্মজীবনীকার মিলে মিশে যান পাঠকের সাথে। ঠিক এ জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন জীবনীকারের রাইজ্যোমাটিক রূপকল্পের বাইরেও কোথাও যেন মণীন্দ্র গুপ্ত আমাদের হাত ধরে নিয়ে এসেছেন একেবারে স্মৃতির কাছাকাছি, একেবারে আদিম সরোবরটির কাছাকাছি যেখানে সংকরায়িত গদ্যের আগেও একটা কাদামাখা আস্ত জীবনী আমাদের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করছে। আর তাই কেবল ধোঁওয়াটুকু নয় আত্মজীবনীর ওই আগুনেও সংঘবদ্ধভাবে পুড়ছি আমরা।  যতটা না মাঘী পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পড়া এই আত্মকথা তার থেকেও অনেক বেশী উজ্জ্বল সে চট পেতে লন্ঠনের আলোয়। সুখ আর দুখে বিভাজিত মানুষগুলোকে, পলকদৃশ্যগুলোকে, আচম্বিত শব্দগুলোকে একেবারে ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত আর পাঠককে দরজা খুলে দিয়েছেন ওই ভেতরেরই। আর এভাবেই জীবনীকারের অলক্ষ্যে একটা রিডার্স রেসপন্স থিওরী একটা পাঠক প্রতিক্রিয়াবাদ গড়ে উঠছে। একটা নির্দিষ্ট কালভাবনার শেষে পাঠক সেখানে খুঁজে পাচ্ছে তার স্বরূপত্ব তার স্বকীয়তাকে।

‘জমিনবৃত্ত’ খুঁজতে মণীন্দ্র গুপ্ত যে বারবার এক সমৃদ্ধ জগতের দৃশ্যগুণকে মেলাতে চেয়েছেন বা আঁকা না আঁকার মাঝে মজুত গুপ্ত রঙের প্রয়োগ করেছেন মানুষের মনের রহস্যে তা এক অমোঘ সিনট্যাক্সিং- “আকাশে দুচারটে তারা ফুটে উঠল। ফিসফিস করে কেউ মনের মধ্যে শুধোল, অস্তিত্বগুলির রূপান্তরিত হবার ঐ নিজস্বধর্মই কাল নয় তো ? আরো ভাবতে ভাবতে দেখি, যখন সম্পূর্ণ জগৎ প্রলয়ের সীমানার মধ্যে চলে যাবে, সেই পূর্ণ অনস্তিত্ব বা শূন্যতা ভরে যে না-থাকার মতো করে থাকে বা থাকার মতো করে না থাকে সেই হচ্ছে কাল। প্রলয়ের আগে পরে যেমন কাল নেই, শুধুই প্রবাহ, তেমনি প্রলয়ের মধ্যে প্রবাহ নেই, শুধুই কাল”। হ্যাঁ, কালই মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজৈবনিক সমগ্রতা, অরগানিক হোল, কিন্তু কাল কে প্রমাণ করতে কেবল নন্দিত উৎসবের অভিসারী হননি তিনি বরং তাঁর সামগ্রিক স্মৃতিকে আঁধার নির্মাণকে জীবনের বহুরৈখিকতাকে উৎসর্গ করেছেন কুকুরবেড়ালফড়িংগিরগিটিপুকুরনুড়িফিঙেভাঁটফুলবাঁশবন আর রাতের ছায়াপথকে। আর তফাতটা এখানেই ঘটে যাচ্ছে। আত্মজৈবনিক আর্কিটাইপ থেকে বেরিয়ে এসে এক বহুস্তরা ‘আমি’র কাছে অনুরণিত হচ্ছে তাঁর আত্মজীবনী। যা প্রোথিত হয়ে আছে মণীন্দ্র গুপ্তের ফেলে আসা পোড়া ফানুসের মত বেঁকে তুবড়ে কালো হয়ে যাওয়া ঘরগুলোতে, সেখানেই প্রবুদ্ধ পাঠক পেয়ে যাচ্ছে তার নিজ গ্রহণসত্ত্বা। আর এভাবেই সাহিত্যসত্যের ভেতর গুটিসুটি ঢুকে পড়ছে পাঠকের গ্রাহকসত্ত্বা। ভাষামাধ্যমে খুঁজে নিচ্ছে ভাষ্যের অধিকার। মাটি থেকে উঠে আসছে যেসব চরিত্ররা তারা আরও বড় ডায়েমেনশন নিয়ে ঢুকে পড়ছে আমাদের লুকোনো বাগানগুলোতে আমাদের লুকোনো দরজা দিয়ে। এ আত্মজীবনী তাঁর প্রথম বাইশ বছরের অথচ তার স্বকীয় জলবায়ুর গুণে সে যেন আমাদেরও একটি প্রদেশ দখল করে বসে থাকে অচিরেই। জীবনকথা বলতে বলতে মণীন্দ্র গুপ্ত কখন জানি ঘেঁটে দিয়েছেন জনপ্রাণীর জেগে থাকাগুলোকেই। যেসব স্মৃতিকে জীবিত করে তুলেছেন চেতনায় সে চেতনার রাজ্যে পাঠকের ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠায় আত্মজীবনীকারের বায়োগ্রাফিকাল এলিমেন্টের ভেতরে পাঠকও তার জীবনী উপাদান খুঁজে নিয়েছে। আর মণীন্দ্র গুপ্ত তো নিজেই অক্ষয় এক মালবেরি গাছের চারিদিকে ছড়িয়ে রেখেছেন অনন্ত সংখ্যক হাত অনন্ত অন্যমন অনন্ত প্লাবিত নির্জন। জীবন ও সাহিত্যের সংযোগ ‘অক্ষয় মালবেরি’ তে এতটা সুস্পষ্ট যে একটা মাডি কালচারের মাঝে একটা ক্রস মিডিয়ার মাঝে মণীন্দ্র ব্যক্তিগত প্রতিফলন পাঠকের প্রাসংগিক হয়ে উঠেছে, যেখান থেকে একধরনের সংক্রামিত জীবনউৎসব পেয়ে যাই আমরা,স্ বতন্ত্র্য থেকে স্বাধীন চয়ন। প্রবুদ্ধ পাঠক যুক্ত হয়ে পড়ে পাঠের অবচেতনকে উন্মোচিত করার কাজে আর তাই প্রতিটা পাঠকের কাছেই ‘অক্ষয় মালবেরি’ যেন এক একটা স্বয়ং পৃথিবী, যা কখনও মুছে ফেলা যাচ্ছে না ছিঁড়ে ফেলা যাচ্ছে না বরং শীত পড়ার আগে তারই দিকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে কিছুটা পরিপূরক উষ্ণতা। অতীত পাঠের মধ্যে পাঠক খুঁজ়ে নিচ্ছে নতুন পাঠের সম্ভাবনা, যেখানে নিজের ভাষা আর আঙ্গিক তৈরীর পরে ইহকাল আর পরকালের মাপগুলো জানবার পরে আদতে একটাই প্রকল্প, ফাঁক ফোঁকরের এই পৃথিবীতে একটাই ইনহিবিশন। আমাদের গড়ানো জীবনের অধিবিদ্যা যেন ধরে ফেলেছেন মণীন্দ্র গুপ্ত আর ইকোয়েশনের মানুষগুলোর দিকে, বয়ন-শরীরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন নতুন এক আন্তর্বয়ন যার চারদিকে খড়ি কেটে একটাই ভবঘুরে আত্মা খুঁজছি আমরা, একটাই মুখ বাড়ানো বাড়ি অথবা তাড়িত মানুষেরা সারা গায়ে রোদ নিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে স্মৃতির রিফিউজিগুলি। “We are …only the stories…. Only the metaphors…we tell about ourselves”। উনিশশো শতকের ‘ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভ’ বেষ্টিত আত্মজীবনী থেকে ক্রমশ যে ‘রিয়েলাইজিং দ্য সেলফ’ আত্মজীবনীর জ্বালানী সংগ্রহ শুরু হল, সাক্ষ্য দেওয়ার আগে গুলিয়ে দেওয়া হল প্রতিবিম্ব তাই যেন ‘অক্ষয় মালবেরি’র কোষপ্রাচীরের উৎসেচক। আমাদের দূরবীন ক্রমশ ছোটো হয়ে যাচ্ছে মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মজীবনীর নৈকট্যে। কোথাও যেন পূর্নবাসনের আশায় কুড়িয়ে পাওয়ার আশায় আমরাও ফিরছি ওই মালবেরি গাছের দিকে। জলের ভেতরের সিঁড়িগুলো দেখবার জন্য আমরাও যেন ডুব দিচ্ছি বেতনা নদীর অনির্নিত আঁধারে; সেখানে জলের বিশেষ তাড়া নেই কেবল ভাড়ার নৌকো, মাছ ধরার নৌকো, মাটির হাঁড়ি কলসির নৌকো, ধান চালের পেটমোটা নৌকো ভেসে যাচ্ছে আমাদের প্রাগৌতিহাসিক স্নান নিয়ে ।

মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মজীবনী মানেই কি সেখানে গভীর ভাবে কেবল বিজড়িত শিল্পীর নিজস্ব মনস্তত্ত্ব ! নাকি সেই পরিসরের মাঝে জল ছিটিয়ে জিইয়ে রাখা আমাদের প্রতিটা জন্মদিন ? মনে পড়ে যাচ্ছে তারকোভস্কির ‘মিরর’ ছবিটা, ছবিটা পুরোপুরি তারকোভস্কিকে ঘিরেই, কেউ হয়ত খোলা চোখে সেটা দেখতে পাচ্ছেননা কারণ কথক কেবল সেখানে এক অদৃশ্য পারফিউম স্প্রে করে দিয়েছেন পর্দার আড়ালে থেকে। অর্থাৎ সঠিক অর্থেই আয়না, স্মৃতি দিয়ে পুঁছে দিলেই একে একে ফেরত পাঠাচ্ছে ঘরহারাদের ঠিকানা। ওখানে কারা কারা ছিল ? শৈশবের বাড়িটা ? বাড়ির ভেতরের অন্ধকারটা ? প্যারাফিন বাতিটা নাকি নিভে যাওয়ার অপেক্ষাটা ? একছুটে পাহাড় পেরোনোটুকু ছিল নাকি বোঁচকা নামিয়ে বসে পড়া ভেজানো দরজার ওপাশে, অভিযোজনের ওপাশে ! অনেকগুলো দৃশ্য অনেকগুলো সখ্য অথবা একটা গান রঙের সম্পূর্ণ বাগান। আর আমাদের নৃতাত্ত্বিক নস্টালজিয়াটুকু আরও একটু ঠান্ডা ছায়ার খোঁজে ওই দৃশ্যের হাত ধরে ধরে আরও গভীর বনে ঢুকছে। এই সম্পর্কবহনই কোথাও অগুনতি দর্শকের কাছ থেকে একই প্রশ্ন করিয়ে নিয়েছে তারকোভস্কির উদ্দেশ্যে- ''আপনি আমার জীবন জেনে ফেললেন কী করে ?'' আর এত খুঁটিয়ে অতীতকে ফের বানিয়ে তোলার প্রসঙ্গে তারকোভস্কিও বলেছেন- “এ তো ঠিক অতীত নয়, এ হল আমি সেই অতীতকে যেভাবে ভাবছি সেটা। না, আমি যে ঠিক আমার নিজের মনগড়া স্মৃতির একটি আকার খোঁজার চেষ্টা করছি তা নয়, বরং আমি চেষ্টা করছি অতীতে ঠিক যেমনটি ছিল সেইরকম করে গড়ে তুলতে; বলা যেতে পারে, আমার স্মৃতিতে ঠিক যে অতীতটা ধরা আছে, তার একটি হুবহু প্রতিলিপি তৈরী করতে চেষ্টা করেছি……স্মৃতির প্রিজমের ভেতর দিয়ে প্রতিসারিত সত্য।'' (অনুবাদ-পরিমল ভট্টাচার্য)। ‘অক্ষয় মালবেরির' পাশে বসে আমাদেরও ইচ্ছে হয় মণীন্দ্র গুপ্তকে একটিবার বলি – “আপনি আমার জীবন জেনে ফেললেন কি করে?” এই মালবেরিকে ঘিরে মণীন্দ্র গুপ্ত যে একা নন বরং তার আশেপাশে মানুষের ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে ভূত ভবিষ্যৎ আর বর্তমান নিয়ে আমাদেরই উদ্ভাসিত কথাবার্তা রয়ে গেছে নবপ্রসবিনী হয়ে। কোথাও খন্ড বলে কিছু নেই ভাঙাচোরা বলে কিছু নেই ভুল রাস্তা বলে কিছু নেই। আর ফিরে যাওয়া ? সচরাচর আত্মজীবনীতে আমরা পাই একটা অসহনীয় আলো থেকে সহনীয় অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার  প্রসঙ্গ ও পদ্ধতি, পাঠক হিসেবে আমরাও মাচা বেঁধে থাকি কখন উঠে পড়ব পূর্বপুরুষের দৃশ্যকল্পের পিঠে, তাড়িয়ে উপভোগ করব ছেড়ে আসাকে অস্থিরতাকে অসহায়তাকে, আর ফিরেও আসব। কিন্তু ‘অক্ষয় মালবেরি’তে যেন স্মৃতির কাছে অসহায় পতঙ্গের মত আত্মসমর্পণ করলেও বিচ্ছেদের মাঝখানের কালো ছোপটা নেই, কারণ কোনো ফেরা নেই যে সেখানে। আমরা পাঠকেরা যেন ওখানেই ছিলাম, আমরা পাঠকেরা তো ওখানেই আছি, অহর্নিশ অভিযাত্রী হয়ে...

শেষমেশ নিজেকে এই বাইরের বড় জগতটা থেকে কক্ষচ্যুত করে ‘অক্ষয় মালবেরি’র ওই ছোট্ট ধূসর কুঠুরিতে কোষে ঢুকিয়ে দিলেই মনে হয়- যা হতে ভূতসমূহ জাত হয় আর যার দ্বারা ভূতসমূহ জীবিত থাকে এসবই একজন দ্রষ্টার একজন প্রাজ্ঞের বিচিত্র জগত আর  এই জগতের অদৃশ্যং অগ্রাহ্যং অচিন্ত্যম অবস্থায় পৌঁছতে জাগ্রত আর স্বপ্নের মাঝামাঝি তিনি পুঁতে রেখেছেন এক অতীন্দ্রীয় মালবেরি গাছ। অজস্র ঝরা পাতার মাঝেও যে অনন্ত সেলাইয়ের শব্দ নিয়ে জেগে থাকে। যেন বাইরের সবটুকুর প্রতিফলন সবটুকু ফেলে আসা লহমা ওই ভেতরে। এ গাছই তার জাগরিতস্থান যা তুমুল স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে বেড়েছে বৈশ্বানর জগতে। যাকে দেওয়া হয়েছে ‘অক্ষয়’ নামের এক অনশ্বর নাশহীন অমর অফুরন্ত অব্যয়। সে মরে না ; ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা অ নিয়ে আপ্তি নিয়ে আদি নিয়ে বেড়ে যায় প্রজাতির প্রদশর্নীতে। জায়মানের বালি আর জলে সিঁড়ি বানায়, তালা ভাঙে, চুরি করে চোদ্দভুবন, ছেলেমানুষ হয়ে ছায়ার মধ্যে হাঁটে। ভারী বাতাসের হাওয়া লাগলেই দেহজ গানে খুলে পড়ে তার সিঁধকাঠি। মানুষের অভাব দেখতে দাঁড়িয়ে আছে ওই গাছ, অভাব পূরণ করতে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্থূল শরীরের বাইরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব ল্যান্ডস্কেপ মেখে আছে ওই মালবেরি, ছোটোবেলাকার বড় বড় বেলুনগুলো আটকে আছে তো ওখানেই কিংবা কাদায় আটকে যাওয়া পাগুলো অথবা ঝোপঝাড়ে থেকে যাওয়া ঝাটিঙ্গাগুলো! এই এনক্রিপ্টেড হুইশপার নিয়েই ভরাট হয়ে আছে ওর অনন্ত ভাঁড়ার। আর তারই ভেতর বসে জীবনচরিত লিখছেন মণীন্দ্র আর লক্ষ্য রাখছেন দেহযন্ত্র ছেড়ে লাটিম রেখে ফানুসের দিকে দড়ি কেমন দীর্ঘ হয় অথচ গতজন্ম ইহজন্ম কিংবা পরজন্মের তর্ক পেরিয়ে জমা হয় স্মৃতিবিজড়িত মধুরস, যার একটানে মানুষগুলো উলঙ্গ, এক টানে ভেতরের সাদা অখন্ডকে সাম্পানে তুলে ঘরে ঢুকছে সে, ঘুমে ঢুকছে। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মাঝে কেবল এক অক্ষয় মালবেরি আর তার চারধারে ঘুরতে ঘুরতে গান হয়ে যাচ্ছে গোয়ালঘরেরগন্ধভাতরান্নারগন্ধবাঁশঝাড়েরগন্ধ। এতসব বিস্ময় উৎসারী গন্ধরা মানুষকেই বহন করে আছে, বহন করে আছে সাদা হাড় আর হিজিবিজি দাগ কাটা এক শূন্য যাপন, যেখানে সুখ ও দুঃখের ধারণা কেবল স্নায়ুর গন্ধে ভেজা। 'অক্ষয় মালবেরি'র প্রথম পৃষ্ঠাতেই মণীন্দ্র গুপ্ত বসিয়ে গেছেন সেই অমৃত বৃক্ষকে যার পাতাগুলো ধূসর যার পালকগুলোতে নেশা লেগে আছে, স্মৃতি লেগে আছে, ওর মনোলোকে এক বৃহত্তর থাকার নেশা, মানুষ দেখার নেশা, মেঘাতিমির দেখার নেশা। আর এখান থেকে পাতা ছিঁড়ে পড়লেই ছোট্ট ছেলের মত মণীন্দ্র যেন বলে উঠলেন- দেখো, স্মৃতি, স্মৃতি, ওই তো আমাদের দৃশ্যকে পেরিয়ে দুলে দুলে নামছে স্মৃতি– ছবির ভেতর দিয়ে গানের ভেতর দিয়ে শব্দের ভেতর দিয়ে। আদতে এই অনেকক্ষণে ভেতর এই অদ্ভুতেড়ের ভেতর এই অক্ষয় মালবেরির ভেতর স্মৃতি ছাড়া কিছুই নেই, আর স্মৃতি কেমন দেখো- পৃথিবীর আমজামবটবনটন ঘুরে এসে ভাঙা মুখখানিকে ভিজিয়ে দিয়ে কেবল কিছু সূর্যাস্তের টুকরো ! যারা ঘাসের মাদুর তুলে ফিরে যাচ্ছে …..



Facebook Comments


Google Comments